একটি করে কবিতা
প্রদর্শশালা-১
বেনু দত্তরায়
সে আমাকে দেখতে পেলেই
হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে উঠবে-
ভালো আছো তো হে
আশ্চর্য শিল্প – এই
জীবনকে মেলানো-
আশ্চর্য হাড় জিত খেলা
যুদ্ধফল
দান-প্রতিদান
জীবনকে দেখে চলে যাব
চা দোকানি জিৎ বাহাদুর বললো-
খবর না নিয়ে সরে পড়ছিলেন
আমরা এখন আলাদা হতে চাচ্ছি
একসাথে আর থাকা গেল না
তা’বলে পুরনো দোকানে
এক পেয়ালা চা খেয়ে যাবেন না,
সে কি হয়
মেধার কাচের নীচে
যশোধরা রায়চৌধুরী
তবুও গেল কি ভুলে? আতশে শরীরই খাঁক
পুড়ে যাওয়া ছ্যাঁকাদাগে ছিটছিট সমস্ত অন্তর
শেষ অবধি তো, জানো কী কী, সকলেই শীতল বরফে
পৌঁছবে ধারালো ব্লেডে, গিলেটিন খাঁচার তলায়
ক্ষুরধার তীক্ষ্ণফলা মুহুর্তে ওপর থেকে নেমে
ছিন্ন করবে স্নায়ু তার, জীবন ও তোমার ভেতরে…
এসপার ওসপার হবে ক্ষণমাত্রে সূক্ষ্মতম সুতো
দ্রুতগামী কাচ এসে তোমাকে মেধাবী কেটে দেবে
বিবর্তনের আগে
রঙ্গীত মিত্র
অতনুদাকে ফোন করে
এবার বলতে হবে
লেখা পাঠাবো?
এদিকে আমাদের বাড়ির গায়ে অসন্তোষ লেগে আছে।
এখানে যেন অন্ধকারের বার্ড স্যাংচুয়ারি।
কিন্তু পাখিরা আসে না।
পাখিদের বদলে তাদের লৌহ-কলকব্জা আসে বলে
নিজেকে ভয় হয়।
বিবির্তনের আগে জলপাইগুড়ি চলে যাবো।
আমাকে পাখি হতে শেখাবেন?
দূরত্ব
রাজীব সিংহ
জলাশয় কালো আলকাতরায় পরিপূর্ণ। বাতাসে
সহস্রনাগের বিষাক্ত নিশ্বাস। কোথাও কোনও
আলো নেই। ধ্বস্ত চরাচর। খুব কষ্ট হচ্ছে? খুব?
এ অন্ধকারে দম নেওয়া খুব কষ্টকর। কষ্টকর কান্নার
ডুবসাঁতারে জোড় করে ভেসে থাকা। এই অনন্ত অপেক্ষার
শেষ কোথায়! শেষ হয় কোথায় উন্মুখ এই পথ চেয়ে
বসে থাকার! জলাশয়ের জমাজলে ভেসে থাকে
পুরনো অ্যালবাম। পরমের খোঁজে তোলপাড় এই অচিন দেশ।
কেউ কি চেনা ছন্দে ডোরবেল বাজাল? কেউ কি ডাকল
নাম ধরে? যার জন্য এখনও উন্মুখ সারাদিন। অপেক্ষার প্রহর জুড়ে
সারাটা সন্ধ্যে। দাবানলের আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে
আলোহীন আকাশে। চাপ চাপ রক্ত পড়ে থাকে
প্রসূতিসদনে। পঞ্চভুতে। এই রাতে সমগ্র জুড়ে
কানে তালা-লাগা সংকীর্তনধ্বনি। উন্মনা মন ছুটে
যেতে চায় অচেনা ব্রিজে। অচেনা সর্পিল পথে।
বয়স্ক বৃক্ষগুলি কতদিন এ পথে হাঁটেনি।
কতদিন সাইকেল এসে দিয়ে যায়নি দুধের পাউচ।
বিকেলের মাঠে অবিশ্রান্ত মশা আর জোনাকির আনাগোনা…
নিরাপদ দূরত্ব থেকে খোঁজ নিই ফোনে।
বড়ো বেশি কথা বলা হয়
কৃষ্ণপদ কুণ্ডু
এদের আলাপচারিতা নিরাভরণ পোষাক-আশাক
মানুষ খোঁজ রাখে না মাটি, সম্পর্কের আদান- প্রদান
মৃদুতম পাতা খসার পতনসমূহ বৃক্ষের চুপকথা!
আজকের হত্যাপ্রবণ সময়ে নিত্য কলহদিনে
আমি সুমিকে ডেকে বলি হত্যাযজ্ঞের ক্ষারবিষ-কথা…
বৃক্ষের সম্পর্কে প্রকৃতপণয় শুরু করতে পারি না?
নিমন্ত্রণ
শুভেন্দু পাল
তাকে গড়িয়ে যেতে হয়
এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে এখন
তার সারা গায়ে অসম্ভব ধুলো
লোকে ঠিক চিনতেও পারছে না
হাতে প্রজাপতি ছাপা কার্ড
এয়ো এক ভালো থাকা। বুঝি
শুধু সারা গায়ে বড় বেশি ধুল!
আরও সুদূর
সেলিম মণ্ডল
১
যে প্রেম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে চেয়ে
মন্দিরের শঙ্খধ্বনি শুনল না, তার জন্য কি সিন্নি বিলোবে?
মুখমিষ্টি সমস্ত সমীকরণে একটা রাফখাতা টেনে বেড়ায়
লাল-কালো পিঁপড়ে
২
কঙ্কালের শুভ্রতা আমাদের চিরুনির কাছে ঋণী করবে কিনা জানি না
উজলার নীল রং যত বেশি বয়ে চলে
একটা শরীর চেনা ধস থেকে তখন ফিরে যায় বাড়ি
৩
দেখা হলে কোনো স্বপ্নের মধ্যে লাল কাপড় মুড়িয়ে আবার হেঁটে যাবে
ওই রাস্তাই প্রস্তুত করতে চুলে বেঁধেছে জট
জট ছাড়াতে চাইলেই নেমে যাবে ঝুরি
রক্তক্ষরণ
অভিজিৎ পাল
১.
অনেক মিথ্যাকে ভালোবাসেন আপনি। অনেক মিথ্যাচারকেও। আপনি হয়তো জানেন না একটার পর একটা মিথ্যে আপনার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আপনি কুয়োর ব্যাঙের মতো উপুড় হয়ে আকাশ দেখে ভাবছেন, পৃথিবীতে এই কুয়োটাই একমাত্র সত্য। ভরসা রাখুন। আপনাকে কুয়ো থেকে বের হয়ে আসতে আমি আর অন্তত অনুরোধ করছি না।
২.
সারাজীবন শিল্প শিল্প বলতে বলতে ওরা ভেবেছিল, সাজানো মিথ্যাগুলোকে একদিন সত্যি করে দেবে। কোনোদিনই ভাবেনি একদিন আগুন আসবে ভেতর থেকে। নিজের জ্বালা থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসতে চাইবে দগদগে ব্যথা। না, আমি তোমার আত্মদহনের প্রার্থনা করিনি এখনও।
৩.
মুঠোর ভেতরে লাল ফিতে বাঁধা সার্টিফিকেট ধরে হয়তো ভেবেছো ওটাই তোমার দারুন একটা অ্যাচিভমেন্ট। আমরা হাসিনি ওসব দেখে। আমরা জানতে পেরেছিলাম কীভাবে দুয়ে দুয়ে মিলে চার সাজানো যায়। সাজানো যায় আপসেট হওয়ার নাটক। এরপরও আমরা সব জেনে বুঝে তোমার ওপর হাসিনি। এটুকু বলতে পারি, একদিন তোমার খেলাঋদ্ধ অ্যাচিভমেন্টটাই তোমার দিকে তাকিয়ে হাসবে, আমরা আজকের মতো সেদিনও চুপ করেই থাকব।
৪.
একে একে দূরে যাবে সবাই। কেউ কেউ নয়, সবাই। জীবনের অর্থ আমাদের কাছে নেই। শেখায়নি যিনি শিখিয়েছেন স্বার্থপর হয়ে ওঠার একের পর এক পাঠ। পাপ ছাড়ে না, ছাড়ছে না আপনাকে। কুমীরের চোখ দেখে এখন ছেলেমেয়েদের হাসি পায়। ওদের ছেলেবেলা থেকেই শেখানো হয়েছে রাখাল ছেলের গল্পটা। এবার তোমাকে সত্যি বাঘে ধরেছে। আমরা আর ফিরে তাকাচ্ছি না।
৫.
আমি দেখেছিলাম তাকে। সেই ছেলেটাকে। যাকে তোমরা বিনা কারণে অপমানিত করিয়েছিলে। ওর হাসিটা মুছে দিতে চেয়েছিলে হিংসায়। পেরেছিলে তোমরা। একা নও, অনেকে মিলে! কেউ বলেছিল, কেমন দিলাম! কেউ বলেছিল, হিপ হিপ হুররে! আমি সেদিনও চুপ ছিলাম। দুঃখগুলো ওর থেকে কেড়ে নিতে পারিনি বলে আজ আমাকে রক্তক্ষরণের মধ্যে দিয়ে আত্মশুদ্ধি করতে হবে।
ক্ষ্যাপা মন
দিব্যেন্দু স্বর্ণকার
গুটিকয় আলো রেখো দীর্ঘতম সব বনপথ
স্বভাবসুলভ মন লোকায়ত ভালো মন্দ রেখে
সময় ফুরিয়ে ফেলি জ্বল জ্বল কঠিন সময়।
অস্তগামী নীলরোদ কাছাকাছি এনে দেবে কেউ?
কোথায় সহজ ঘর কতদূর সহজ নগর
গভীর অবাকজল খরকূট পাই না কিছুই…
অতিলৌকিক
ছন্দম মুখোপাধ্যায়তাকালাম, হলুদ গোলাপি রোমে
ঢেকে গিয়েছে তাঁর শরীর, ও চুপচাপ
দাঁড়িয়ে থাকে যখন মাঠ ছিল,
দু’জনে বসে কথা বলতাম। আজ
এই বারান্দায় কি জানতে
এসেছে সে
কালবৈশাখীর মেঘে আকাশ
ঢেকে আছে। জোড়ালো, গরম
হাওয়া পুরনো স্মৃতির মতো
ছুঁইয়ে দাও কানের ডগা
আমার বুড়ো ঘর
ভুল নদী
সৌরভী রায়
একটা মানুষকে চিনে যাই, খাই দাই, অন্যকে চেনাই।
তারা চায় একটা সময়। সময়টা নষ্ট করার জন্য।
গোপন বিশ্বাস
ওয়াহিদা খন্দকার
কাগুজে আলো ফিরিয়ে দেয় গরাদের ওপারে।
সাদা খাতায় ছত্রাক আসে কখনো ,
ঈষৎ বিষন্ন হয়ে গুমোট গন্ধ ওঠে...
তবু সারাদিন চুপিচুপি স্বপ্নিল মোট বয়ে ঘুরি
মাথা কুটে মরি নিবিড় ঘনত্বের দিকে
থাক রাজপথে আলো নেভানো
থাক উপুড় করা কলসি
অন্ধকারে গোপন খামে, গোপন ব্যাথার বিশ্বাস
মন চাইলে ফিরে এসো
রানা সরকার
বিশ্বাস করো স্টপেজ থাকা সত্ত্বেও আমার গাড়ি দাঁড়ায়নি কোনোদিনই।
খুব হিংসে হয় “এখানে গাড়ি দাঁড়ানো নিষেধ” অথচ কত গাড়ি দাঁড়িয়ে।
আরও বেশি হিংসে হয় যখন দেখি তালমা নদীর জল নতজানু, বৃদ্ধ দম্পতির পায়ে।
আর বাতাসে ভেসে আসে নিবেদনের সুর-
“জনম জনম ফিরি চাং মাটির জীবন। তুই আর মুই”।
আসলে নদীর পাড়ের কবরটাও ভীষণ পছন্দের
যেখানে নৈশব্দেরা চিৎকার করে প্রতি রাতে
মশাল নিভে যায় অভিমানের কাছে।
শাল গাছ বিনম্র ভাবে জানায়-
“একবার আইসেক, কনেক রহো, হিয়াখান জুরাক”।
নদীর জল শুকিয়ে এলে, রৌদ্রবালিতে তুমি লুকিয়ে গেলে !
আচ্ছা এসব তত্ত্বের কথা বাদ দিলাম। বাদ দিলাম
নদী, আলো, বাতাসের কথা। এমনকি বাদ দিলাম
কিন্তু মাটিকে কি করে বাদ দিবে বলো !
দিনশেষে মন চাইলে ফিরে এসো তালমা নদীর ধারে
ভাঙা মাটির ঘরে।
শূন্য, শ্মশান, জেব্রাক্রসিং- দুই
নীলাদ্রি দেব
ব্যস সময় শেষের পরই লন্ঠন জ্বলে ওঠে
আদিগন্ত সবুজ মাঠ
সাইড লাইন বরাবর লোমশ সোয়েটার
এসবের পরই ট্রাফিকের বাতি
মাঝরাতের পর মদ্যপ বার্তালাপ
বার্তালাপ শব্দটি নিয়েই অভিযোগ আছে
আর বাকিটা, তোলা থাক
সমস্ত বিরতি আসলে দ্বিচারিতা
আলো মাত্রই চতুর্ভুজ, আগুন, শ্মশান বিষয়ক
শুধু একক উন্মোচন!
কৌশল
পঙ্কজ ঘোষ
নদীর কাছে গিয়ে দীর্ঘক্ষন বসে থাকিশিখি নির্জনতা ভাঙা ও প্রবাহ
বড়ো বেশি চুপ হয়ে গেছি আজকাল
অরণ্যের ভিতর গিয়ে দাঁড়াই
শিখে নিই কিভাবে অস্থির হতে হয়
আসলে এ সবই আমার ভেতরে বসে থাকা
তোমাকে হত্যার কৌশল।
বছরভর
আমি বসে থাকি
তুমি বসে থাকো
আমরা উঠে যাই আপেল বাগান হতে।
প্রতিটা জন্মদাগের পাশে
আমি লেগে থাকি
তুমি লেগে থাকো
আমরা মুছে যাই তেজস্ক্রিয় বৃষ্টিপাতে।
প্রতিটা সহবাসের শেষে
আমি কেঁদে উঠি
তুমি কেঁদে ওঠো
কিন্তু
আমরাও কাঁদি অসুখের বশে।



2 মন্তব্যসমূহ