তৃপ্তি সান্ত্রা'র কবিতা

 


তৃষার শব্দকোষ

তৃপ্তি সান্ত্রা

প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০০৭
গ্রন্থস্বত্ব :  লেখক
প্রকাশক : অমৃতলোক
মূল্য : ৪০ টাকা
 
তৃপ্তি সান্ত্রার জন্ম ১৯৫৬ সালে মালদা জেলা শহরে। বাবা সুরেশচন্দ্র সান্ত্রা মা বেলা সান্ত্রা। পেশা শিক্ষকতাতৃপ্তি সান্ত্রা বাংলা সাহিত্যে মূলত গল্প-লেখক হিসেবে পরিচিত। কবিতা পাক্ষিকের মঞ্জুষ দাশগুপ্ত নামাঙ্কিত পুরস্কার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার, ২০০৬, গল্পমেলা পুরস্কার,২০১৭, হিতেন নাগ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ২০১৭, সান্নিধ্য স্মারক সম্মাননা, ২০১৬, কবি দিলীপ তলোয়ার স্মৃতি সম্মাননা, ২০১৯ এবং সর্বশেষ ঐহিক সম্মাননা, ২০১৯,৷   লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা কেন্দ্রের  ছোটো গল্প সম্মাননা পুরস্কার ২০২০, পুরষ্কারে  ভূষিত হয়েছেন।
গদ্য দিয়েই লেখালেখি শুরু হলেও কলেজের সময় ও পরবর্তীকালে  তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন। ইতিমধ্যে কবিতার বই বেরিয়েছে চারটি- কত দীর্ঘ হলে মূল’, ‘নিষাদ কলম, তৃষার শব্দকোষ’ছোপছোপ কাটাকুটি
এই পর্বে আজ তৃপ্তি সান্ত্রা’র তৃতীয় কাব্য গন্থ ‘তৃষার
শব্দকোষ’ থেকে পাঠক’দের জন্য রইলো একগুচ্ছ কবিতা।
                   




কৃষ্ণ প্রেম


স্বপ্নের আগে তোমাকে দেখেছি
স্বপ্নের পরে তোমাকে দেখেছি
স্বপ্নে তুমি কি মনে পড়ে না
 
জন্মের আগে অন্ধকার
জন্মের পরে অন্ধকার
তবুও কেন আঁধার চেয়েছি
কেন গাঢ় অন্ধকার
 
ও হাত কখনও ছুঁইনি
ও হাত কখনও ছোঁব না
ও হাত ছোঁবার কথা ভেবে ভেবে
রোজ তবু রাত্রি হব।
 
 
 
 

শিউলিকথা

 
তোমার করম্পর্শে আমার জলশরীর।
যাবতীয় গৃহ সন্ততি শস্য অক্ষর জ্বর
আসনপিড়ি গৃহসজ্জা সব তোমার।
 
দুঃখী মানুষের একলা বাঁশিটির সুর
খিড়কি বেয়ে এসে বন্ধ ঘরের আঁধারে ধাক্কা খেলে
তোরঙ্গ খুলে তোমার গান শাড়ির জোছনা মেলে দিই।।
ঘষা কাঁচের চশমা নামিয়ে
জাবদা খিচুড়ির চাল ডালের কাঁকর বাছি।
অশান্ত অসংখ্য অযোধ্যা ক্ষুধা কে
ভাঁজকরা রামায়ণের পাতা থেকে দিই
তপোবন ফলমূল
নাগপঞ্চমীর দিন
ধানদুব্বো হাতে তোমার ব্রতকথা শুনতে আসে
শঙ্খচূড়, গহমা, চিতি
আল ছেড়ে আসে মাছুয়া আলাদা যম।
দরজা খুলে দিই। ছাপানো সিন্থেটিকে
পিলপিল করে
বেহুলা আসে
ফুল্লরার বারোমাস আসে
আসে রোগা হেঁসেল রোগা বিছানা রোগা পুরুষের
জ্বরবিকার কথা
চোখ ঝাপসা হয়ে কুয়াশা আসে।
কুয়াশা ভোরে।
মা
তোমার সঙ্গে একটা জীবন টুপটাপ
এইসব
শিউলি কথা কুড়োই...
 
 
 
 
 
 
পাঁচটা চল্লিশের বিকেল
 
মেঘলা দিনের পর
এই বৃষ্টি এই মেঘের পর
ঠান্ডা চা আর টানা পরীক্ষা হলের পর
ছটা বাজেনি আর এই বিকেলটা
অদ্ভুত সোনালি
 
মেয়েরা, ধুলোধুলো মেয়েরা রেশন নেয়
ধুলোঝড় ছেলেরা সাইকেলে ওড়ে
 
পুজোয় কিছু কিনিনি
পুজোয় কাকে কী দোব
ভাবছি এক্ষুনি যদি এই বিকেলটা পাঠানো যায়।
কিছুটা এস.এম.এসে . কিছুটা চিঠিতে
আর কিছুটা এই যা খুশি কবিতায়-
 
পাতার ওপরের আলো আর নীচের ঠান্ডা আঁধার
যাদের কেনাকাটা নেই,
কাশফুলের পাঞ্জাবি আর জলডুরে শাড়ির নদী নালা
যারা কেনাকাটা করে না,
চাপ চাপ মনখারাপের মেঘের নিম্নচাপ মেখে
চুয়াল্লিশ বছরে এই প্রথম যারা বাড়িতে না এসে
বাঙালি ট্যুরিস্ট হয়ে হরিদ্বার গেলেন
তাদের দিলাম দেশের বাড়ির পাঁচটা চল্লিশের
এই মন কেমনের বিকেল
 
 
 
 
 
দাগটি
 
শরীরটি চাবুক নয়
সপাট চাবুকের দাগ।
দাগটি যে রুপোলি শাড়িতে ঢাকা
তা বুনেছি সারারাত
হিমে, অঘ্রাণে, ফোঁটা ফোঁটা কষ্টে!
চোখের জল এমন গরম এমন জনপ্রিয় এমন যৌনতা
সমস্ত আড়ালে থাক আজ।
আড়ালে থাকি কলম আর
কলম ধরা হাত
আড়ালে হস্তলিপি যত মুক্তো ও অপুষ্ট ছাঁদ
 
মুদ্রণ হরফে যা
তার নীচে কষ্ট ওপরে কষ্ট
নীচে ঢিমে আঁচ
ওপরে জ্বলন্ত কয়লা
 
দাগটি দীর্ঘ। তাপসহ হয়ে আরোও
দীর্ঘ।
সহজে যাবার নয়--
 
 
 

 
তোমার মনে পড়ল পোস্টমডার্ন বেড়ালের লেখক
 
কার্তিকের হিম ছাদে বসে
কুলোভরা মিথ্যের শস্য থেকে
আলাদা করছি সত্যির কাঁকর...
 
চালে ডালে কাঁকর পেলে মাথা খারাপ হয়ে যায়
এই প্রথম একটাও কাঁকর নেই দেখে
হাঁউ হাউ করে কান্না পেলে
তোমার মনে পড়ল পোস্টমডার্ন বিড়ালের লেখক
মনে পড়ল, মিথ্যের বিপরীত ঠিক সত্যি নয়
 
 
 
 
 
হলাসন
 
জমি। কর্ষণ যুক্ত জমি। সুফলা জমির
উগমায় এতবার ব্যবহার হয়েছি-
আর তোমরা হালচষা কৃষক
 
কে যেন জানতে চেয়েছিলেন—আপনি কি যোগ করেন
শরীরচর্চা করিনি
তবে ইদানীং
হলাসন করতে ভালোবাসি
শরীরটা হাল্কা লাগে। বাঁকানো মেরুদণ্ডটি
সেই বিতর্কিত হাল
যা চিরকালীন পুরুষ অধ্যুষিত ছিল
অল্প
অভ্যাসে আমিও তাকে আয়ত্তে আনি।
 

 
 
 
আর বৃষ্টিতে...
 
আর বৃষ্টিতে চিবুক তুলে ওই আমি
বেখাপ্পা ফ্রক আর নগ্ন শাড়ির রহস্য
কালো কাঠি কাঠি হাত পা
যতই ফিটিংস করো, ফিটিংস হবে না
আসলে একটা দমকা হাওয়া আর
বড়ো বড়ো ঢেউ আর ঢেউ ঢেউ আকাশ
আর এবড়োখেবড়ো পথ
কৃমি হয়ে খেয়ে নিচ্ছে শরীর
পোশাক হয়ে যাচ্ছে ঢলঢলে
আমি পোশাকের মতো হব না
জেনে মরিয়া।
পোশাকও তার নিজেরই মতো
কোমর বুকের মাপ নিয়ে তৈরি।
 
যে পা মাটিতে
আর যে মাথায় লাগামহীন রামধনু
সে নগ্ন। নগ্ন। রহস্যময় নগ্নতা।
যেভাবে,
আগুন আর বৃষ্টির কোনও পোশাক হয় না।
 
 
 

 
তৃষার ঘুড়ি নির্মাণ
 
হাফ সেঞ্চুরির ল্যাপে দাঁড়িয়ে
তৃষা অন্ধকারের মর্চে পড়া চাবুকটিকে দেখে
পাগল হয়ে গেল।
পুরনো রেয়ার কালেকশনস্
একটু অযত্ন, অনেক ভুলভাল ক্ষয়
তবু তেলে আর চর্চায় এ চাবুক জিদ্দি শরীরের
জন্য ঠিকঠাক।
চাবুক তৈরি হলে
নিজের গাধা শরীরটিকে
পিটিয়ে পিটিয়ে তৃষা ঘোড়া করবে
আবিষ্কার করবে
সে তো ঘোড়া নয়
ঘোড়ার স্ত্রীলিঙ্গ ঘুড়ি
আস্তাবলে না ঢুকে ঘুড়ি তখন ভেসে পড়বে আকাশে
 
 
 
 

জামা
 
আমরা হ্যাঙ্গারে জামার মতো ঝুলি
হাওয়াতে দুলে দুলে নেচে ওঠে
জামা।
টানটান তার, নিখুঁত ঝোলায় আমাদের
জামা বাতাসে এদিক ওদিক এমন ঘোরে
সত্যি সত্যি মনে হয় যেন, আমরাই-
কপিশ আঁধারে দুর থেকে মাথা আর পায়ের
অভাব বোঝা যায় না।
যেন মাথা স্বপ্নে দুরে গেছে
যেন পা স্লো মোশনে শিখে নিচ্ছে
ঝড়ের বুকে ঠিক থাকার মার্শাল
আর্ট
পুরোপুরি জামা হবার আগে
সংবেদনশীল খাকি বাতাস
চিরুনি তল্লাশিতে দেখে নিচ্ছে
কার পকেটে নিষিদ্ধ মাথা, কার পকেটে নগ্ন পা...
 
 

 
 
আগুন তাপের হাত
 
এই হাত আগুন তাপায় রাতে
তুমি নও
আমারই অন্য হাতের সাথে
আমরা ব্যস্ত, দিনের তাড়া
ছুটে যাই
যন্ত্র পাগল পারা
 
বৃষ্টি ভিজছে শরীর জুড়ে
ভিজি জ্বর
প্রেমিক অনেক দূরে
 
বাঁ চোখ তবু ডান কে দেখে
রাঙা
নাভির নীচে অথই জল
খুঁজছে যেন ডাঙা
 
এ হাতের হাজার
চুমোর ধুমে
অন্য হাত কাদা তখন ঘুমে
 
 
 
 
 
ওরাই আমি কেউ
 
লিখছি গুঁড়ো গুঁড়ো এই যে একা বাড়ি
তারে তে দুটো জামা তারে তে একা শাড়ি
 
এ জামায় কিছু তুমি ও জামায় কিছু সখা
শাড়িটি চন্দ্রাবলী পাড়টি চিত্রলেখা
 
এ ঘর ফুটিফাটা ও ঘর বানভাসি
ক্ষুধা ও অন্ন আশ্লেষে পাশাপাশি
 
এ ঘরে কবুতর ও ঘরে ম্যাও, ঘেউ
ওরাই আমি কিছু ওরাই আমি কেউ।
 
 
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ