পীযূষ সরকার-এর কবিতা

 



ভাঙা মানুষের রিংটোন

প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর, ২০১৬
প্রচ্ছদ : ব্রতীন সরকার
প্রকাশক : কবিতার লাইটহাউস
দাম : ৪০ টাকা

    পীযূষ সরকার, জন্ম ১৯৮৭, কোচবিহার জেলায় তুফানগঞ্জ মহকুমার বাঁশরাজা গ্রামে। পেশায় স্কুল শিক্ষক। বাংলার পাশাপাশি রাজবংশী ভাষায় সমান পারদর্শী, কবির শখ গান লেখা, সুর করা ও গান গাওয়া।


ভাঙা মানুষের রিংটোন


গীদাল

আমাকে ডেকো না যদি উচ্ছন্নে যাই
নষ্ট হই, প্রেমের অযোগ্য হয়ে উঠি
মাতাল ও বেশ্যাদের দরদাম; খিস্তি ও বিষাদের ভেতর
ভীষণ কবিতা বুনি যদি, ডেকো না
বরং ভুলতে দাও নাম, যশ...
লিরিকহীন গীদালের মতো
 
বৃষ্টি হলে হোক তুমি অকারণ চিন্তা কোরো না
 
আমাদের দুঃস্বপ্নে দেখা, ঘুম ভেঙে গেলে
বলা ভালো কেউ কারও নই
যেমন লোকাল ট্রেনে চেনামুখ ওঠে আর নামে
 
 

হবিস

আমি রোজ অদৃশ্যের মুখাগ্নি করে ফিরি
ভেজা থান, ঠান্ডা শরীর...
হাত সেকতে সেকতে মনে পড়ে সম্পর্ক
প্রচলিত লেনদেন...
গাছ তার নিজের ভাষায় দুঃখ প্রকাশ করে; শুনি
একটা ঠিকানা শুধু চিঠি অবধি নেই
 
মাটির হাঁড়িতে ফোটে একসিদ্ধ অন্ধকার
সারাজীবনের হবিস
 
 

কুকুর 

মৃত্যু পোষা কুকুর আমার বারান্দাতেই থাকে
ফিরলে বাড়ি লেজ নাড়িয়ে মালিক বলে ডাকে
সাদার উপর হাল্কা ধূসর সহজ সরল খুব
ঘুমকাতুরে, নিরামিষাশী, প্রেমের মতো চুপ
যখন তাকায়, গভীর তাকায়, কাব্য করা চোখ
ভিন হরফের ভিন্ন ভাষা ভিন্নদিকে ঝোঁক 
রোজ সকালে হাঁটতে বেরোই,মৃত্যুটিও হাঁটে
কুকুর পোষা মানুষ ক্রমেই বাড়ছে এ তল্লাটে
 
 

পদ্মপুরাণ

মাঝে মাঝে বাহো নামে বুকে
ঘোলাজল, জাকই খলাই
হাত পিছলে বেরিয়ে যায় শৈশব
সোনালি মাছেরা
 
তখন সন্ধ্যা লাগে গুমোট বাতাসে
শোনা যায় কূপবাঁশি, পদ্মপুরাণ
“কোন ফুলে পূজিব মা হে...
 
 মৃত্যুর চোখে মুখে নরম জোনাক
 
মাঝে মাঝে নিজের ছায়ায়
অন্য কাউকে দেখি কলার ভেলায় ভেসে যায়...
 

বাড়ি

একটি বাড়ির স্বপ্ন  ঘুমোতে দেয় না। রাতে
ঝলমল করে ওঠে মুখ, উত্তরের নরম জানালা
হয়তো বা ভুল, হয়তো বা আকাশ পাতাল। ভাবি,
কার কাছে গেলে সব চমৎকার হয়ে উঠবে ফের?
 
সামনের মাস থেকে জিনিসের দাম বাড়বে আরও
শোনা যায়। একদিন ছিঁড়ে খাবে মানুষে মানুষ
খাদ্যাভাবে, প্রেমের অভাবে; হতেও তো পারে
 
স্বপ্নের বাড়ি থেকে মাঝে মাঝে আলো চলে যায়
অন্ধকার খুলে দিয়ে বসে থাকে অন্ধকার কেউ
হয়তো বা ধ্রুব, হয়তো বা উচ্চকিত ভ্রম
যেরকম জলছাড়া ঢেউ
 

বিগত প্রেম 

মৃত্যুর অবধারিত কাছে
আমি খুব নগণ্য আলো...
অথবা ঘটেনি কিছুই তেমন লিপিরূপ;
ধুলো সরালেই পাপ, বিগত প্রেমের
শরীর ভাসতে থাকে নীল দশকের জ্যোৎস্নায়
 
ওকে জেনেশুনে যেতে বোলো
এসব শহরে আর অপরাধবোধ নেই
যেকোনো গলির ভাঁজ মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে
 
'ভালো থাকা' ভুল টার্ম, অবর্তমানে...
 
না-পাওয়াগুলির চোখ নিভে এলে
গভীর ঘুমের পাশে পালাগান রেখো
 

রেডিও-গ্রাম

কুঠিবাড়ি, রায়ডাকের চর...
আমাদের শৈশব প্রকৃতই নদীমাতৃক ছিল
দোতোরা বাজত আর ডারিঘরে গান বুনত গীদাল
সুরের আকাশে শুধু ডাউকির মেলা
 
কালক্রমে সিলেবাসে ভয় ঢুকে গেল
মানুষের স্খলন, বিবেক ও অশ্রুগ্রন্থি শুকোনোর ছবি
মাটির গল্প জুড়ে সুচতুর ফাঁদ 
পাতা হলে বগা ও বগির 
আত্মা শুকিয়ে কাঠ, কাছেই মরণ
 
সেই থেকে জুবুথুবু
চশমার কাচে...
 
ঝাপসা রেডিও-গ্রাম, প্রতিমা বড়ুয়া লেগে আছে
 
 

পুজো


পরিমাণ মতো প্রেমে, এমনকী বেশ্যাও দেবী হয়ে ওঠেন
তাঁর স্তন এবং যোনি থেকে একরকম
আলো বেরোয় তখন...
 
পুজো, হোম, মন্ত্রপাঠ চলে
দূর থেকে প্রনাম করেন কেউ কেউ
ফুল ছোড়েন, খুচরো পয়সা ছোড়েন...
দেবী তৃপ্ত, পুরোহিতের চোখে জল
 
আমরা লেজ নাড়াতে নাড়াতে, যত দ্রুত সম্ভব
জরায়ুর দিকে ছুটতে থাকি...
 
 

নিরাময় ফুল

যা কিছু সহজ তার কাছাকাছি দু'মিনিট বসি
নির্জনতা মনে হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গীতাপাঠ
যদিও সাজানো চিতা মৃতদেহটির সম্মানে
আমার নিশানা প্রেম, ঘাসের রূপক-ভরা মাঠ
 
অনেক দূরের গাছে থোকা থোকা নিরাময় ফুল
ছুঁতে চাই মন্ত্রমুগ্ধ অসময়ে সন্ধ্যা লাগে বুকে
একা চিন্তিত বাড়ি জবলতে জ্বলতে নিভে যায়
শরীর ফুঁপিয়ে কাঁদে আত্মার কঠিন অসুখে
 
 

ননী বর্মন

ননী বর্মনের কথা মনে পড়ে খুব
লোকটা মাতির ছিল, খাটুনি করত দিনরাত
তবু তার উপরওয়ালা মুখ তুলে চায়নি কখনও
শোনা গেছে এটাই কানুন
মানুষের দুনিয়ায় মানুষেরা বড়ই অনাথ।
আমিও জীবন থেকে এরকম অনেক হদিস
পেয়ে গেছি বুরোকালে অবাঞ্ছিত সন্তানের মতো
জেনেছি দ্রব্যগুণ, বিষ
কেউ শেষ কথা নয়, বস্তুভেদে সবাই ভিখিরি
ননী বর্মনের চেয়ে স্বচ্ছল কোনো বান্দা হতেই পারে না
যতই লুকিয়ে থাকো, ধুলো দাও রাষ্ট্রের চোখে
 
একদিন। মৃত্যু ছাড়ে না
 
 

অফবিট

গাঢ় বাদামির উপর কালো রঙ, যেমন স্তন
বাতাস আঁকতে গিয়ে আমি এঁকে ফেলেছি গুজব
আজ খুব মাতাল। টলতে টলতে প্রেমে পড়ার দিন
হাত ভর্তি ধূপছায়া মৃত্যুশোক জন্মান্তর
টিম টিম গান বাজছে, অফবিট। বিশ্বাস করো,
গুজব আমার মা, যৌনসঙ্গী, কাঁদার লোক। একমাত্র
 
জল বাড়লেই বোঝা যায় জীবন নদী বা নদীর...
 
 

মনোলগ

দাঁড়াতে পারিনি ঠিক রোদরঙ রবিশস্য হয়ে
অথবা পানীয়জল সামান্য হাতপাখা সহ
মানুষের চৈত্রমাস, শ্বাসকষ্ট, উচ্চরক্তচাপে
কিছুই দিইনি হাতে ছোটো ছোটো ভাইবোনেদের
আমার আমার করে কাতালাম অযুত সময়
অতিরিক্ত কথা বলে। গাছে গাছে প্রচার টাঙিয়ে
কোন অছিলায় আজ লকায়ত ভালবাসা চাই
 
আমি কি নেমেছি জলে সাঁতার ছাড়াই?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ