শুভেন্দু পাল'এর কবিতা

 

কল্পতরু ক্যাটারার

শুভেন্দু পাল

    প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি, ২০১৫
    প্রচ্ছদ:        দেবাশিস সাহা
    স্বত্ব:           অর্পিতা পাল
    প্রকাশক:      পরম্পরা
    মূল্য:          ৮০ টাকা
               মালদার বাসিন্দা শুভেন্দু পাল, শিক্ষকতার সাথে জড়িত, ইতিমধ্যে বাংলার একাধিক পত্র পত্রিকায় লিখেছেন, পাশাপাশি তাঁর পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে- এইসব যাতায়াতপাশের ফ্ল্যাটের দেবতাআছিপুতুলের মাঠ ও কল্পতরু ক্যাটারার।  শুভেন্দুর লেখায় তাঁর জীবনের স্মুথ জার্নি স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়, পাঠক তা পড়লেই বুঝতে পারবেন।  কল্পতরু ক্যাটারার বই'টির কবিতাগুলিকে কবি তিন'ভাগে বিভক্ত করেছেন, কেরানির বাড়িভ্যালি অফ সাইলেন্স’ ও 'কল্পতরু ক্যাটারার' তিন'টি অংশ থেকেই মিলিতভাবে কিছু লেখা পাঠক'এর জন্য রাখা হল।

 

পরিকথা 

 
পরিরা ঘুমোয় না জানো? অন্তত এ শহরে
যেখানে বাদামের খোলা ভেঙে কে কে
মুক্তো পেয়ে যায়, তারপর শিস দিতে
কেউ কেউ পেয়ে যায় ভূতেদেরও বর
সামান্য পাদুকা যার পর হয়ে যায়
পাসপোর্ট, ভিসা, অলীক উড়ান
 
পরিরা ঘুমোয় না জানো? সারারাত
ভেজা ল্যাম্পপোস্টে বুক ঘষে ডান ঘষে
যদি কোনোদিন, খসে যায় দুটি...
সামান্য বালিকা হয়ে, বধূটি হয়ে
সে-ও কোনোদিন ভাঙতে পারে
একমুঠো তরুণ বাদাম।
 
 
 
 

বাবা যার বিদেশে

 
বিষন্ন মায়ের চেয়ে গাঢ়তর মেঘ আর নেই
কালিপড়া মুখে কত খাল-বিল থমকে আছে দেখি
এদিকে উৎসব ঋতু, লাল জামা হল না এবার
তবু এল সাদাবক, ভোর থেকে আকাশেরও জ্বর
এক্ষুনি মূর্ছা যাব? আমি কি ছোট্ট গদাধর ?
 
ডানার জলজ ভাঁজে পাব বাবা তােমার খবর?
 
 
 
 

বর্ডার

 
রাস্তা চেনা নেই, ভিসা নেই
পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে কবে
তবু দুপায়ে জড়িয়ে নিয়ে কৌতূহলী ধুলো
তারা আজো চুপিচুপি বর্ডার পেরোল।
 
ময়মনসিংহ কতদূর? খোকা, তুমি জানো?
কীভাবে অতটা যাবে? কোন ক্লাস, বলো?
গ্রামটার নাম ? জানা কেউ? আত্মীয়-স্বজন?
 
ঝাপসা সব, তবু বাড়ি ফিরবে বলে
কলোনিবাজার ছেড়ে প্রতিদিন
মাইল মাইল উড়ে আসে
একজোড়া কাঠবাঙাল পাখি!
 
ছোট্ট আমার মা আর একটু বড় বাবা।
 
 
 
 

কেরানির বাড়ি

 
তিনকাঠা জমির উপর এই একতলা বাড়ি
তিনতলা ভিত, দশ ইঞ্চির দেওয়াল
জানালা দরজা অনেকগুলো, সামনে বাগান
যাতে হাওয়া খেলে, যেন খেলে তিনপুরুষের আলো
 
মুখে বলোনি কিছু তবে ভাবতে নিশ্চয়
দশটা ছটার পর ভারী ওভারটাইমের রাত
যে স্বপ্ন দেখাত, তুমি তার কোলেই ঘুমাতে
আর তোমার কোলে আমরা দুই ভাই...
 
তিনতলা ভিত, পঁচিশ বছরে ভেঙে পড়ার নয়
বাবা, তুমি নেই, স্বপ্নটাও পাড়া ছাড়া কবে
ভূমিকম্প হয়নি তবু কেরানির একতলা বাড়ি
কলমের আলতো খোঁচায়
যেন হতভাগ্য দেশ, হঠাৎ দুভাগ হয়ে যায়!
 
 
 

দোল

 
তখন আবিরের রঙ নিয়ে, চরিত্র নিয়ে
আমাদের আলোচনা শেষ হওয়ার মুখে
আলো প্রায় যায় যায়
শঙ্খ বেজে ওঠার অল্প কিছু আগে
আমাদের পাড়া ছেড়ে যাচ্ছে নির্বাচিত অটো
ভিতরে তার সকল নিয়ে বসে আছে
আলুথালু এক আঁজলা লজ্জামুখী জল
কে জানাবে তাকে ‘আজ দোল’
এই সব দিনে অন্ধকেও অল্প কিছু রঙ
নিঃশর্তে মেনে নিতে হয়
 
 
 
 

রেনিডে

 
ভোর। তিনটে কান্না এসে বসে আছে লেখার টেবিলে।
জড়ানো চোখে ঘুম। এখন আসতে পারো
বলেই দেওয়া যেত বেশ!
কী মনে করে ছেলের লাল বল এগিয়ে দিলাম প্রথমটার দিকে।
লাফাতে লাফাতে চলল সেও। গিয়ে পড়ল বাগানের সবুজ ঘাসে।
বাবার বাঁধানো ছবিটা দিলাম দ্বিতীয়টিকে। ধুয়ে মুছে তাতে
একফোটা চন্দনের টিপ লাগাল সে। এ পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল।
শেষটিকে আমার লেখার খাতায় বসতে বলতেই ফুলে উঠল
ঠোঁট। কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে উড়তে লাগল ঘরময়।
তারপর জানালা বেয়ে উঠে গেল অনেকটা উঁচুতে। কী বৃষ্টি!
কী বৃষ্টি! বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়। এক কোমর জল।
জলের ঘূর্ণি-দোলায় কাগজের নৌকো হয়ে এখন
ডুবছে ভাসছে আমার শহর। স্রোত ডিঙিয়ে তুমি
শেষমেশ এসে পৌছবে তো, লেখা?
 
 
 
 

ভ্যালি অফ সাইলেন্স

 
আমার প্রশ্ন তোমার মুখে এসে পড়ে একদিন
তোমার প্রশ্নও একদিন এসে যায় আমার এ মুখে
 
মাঝ বরাবর এই যে শুয়ে পড়া ল-ম্বা নীরবতা
 
হাসিময়, কান্নাময়, ছায়াময়, মায়াময়...
সবকটি প্রশ্নের উত্তর তবে কি একই?
নিঃশব্দ; তবু অ্যাত তার প্রতিধ্বনি হয় !!
 
 
 
 

জেলাস

 
সন্ধ্যা এখন নীলচে কালো ওড়না মত
হ্যাঁ সঞ্জয়, জানি এখন তোরা আবার
মিট করবি, বসেও যাবি ব্লু’ কাফেতে
ফর্সা মতো বেয়ারা সব তোদের সামনে
সাজিয়ে দেবে মোমবাতি আর জমে উঠবে
সান্ধ্যবাসর, যেমন জমে মঞ্চে নাটক
আমি আবার তোদের জন্য এমন সন্ধ্যা
লিখতে লিখতে হাত খোয়াব, চোখ খোয়াব—
বুকের খাপে তরল অসুখ, দিন ঢাকবে কাফ সিরাপে
তবুও আবার তাদের জন্য প্রেমের সন্ধ্যা
লিখতে লিখতে, হ্যাঁ সঞ্জয়, ঠিক ধরেছিস
শরীর ঘিরে হিংসে রঙের রাত নামবে।
 
 

 

নিমন্ত্রণ

 
আনন্দ একটা গোলমতো ব্যাপার
তাকে গড়িয়ে যেতে হয়
এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে এখন
তার সারা গায়ে অসম্ভব ধুলো
লোকে ঠিক চিনতেও পারছে না
 
ঠিক তখনই তুমি এলে
হাতে প্রজাপতি ছাপা কার্ড
এও এক ভালো থাকা। বুঝি।
শুধু সারাগায়ে বড় বেশি ধুলো!
 
 
 
 
 

ডেইলি প্যাসেঞ্জার

 
চার নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে
লাইনের পাশ থেকে দয়া করে সরে দাঁড়াবেন
দুনম্বর লাইন দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে
প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে দয়া করে সরে দাঁড়াবেন
এক নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু ট্রেন যাবে
দয়া করে নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়াবেন
ঘুমের ভিতর দিয়ে প্রতিদিন ছুটে যাওয়া থ্রু ট্রেন
চড়া হুইসল, এক পা দুপা করে সরছি আর সরছি
তখনি স্বপ্নের মতো তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াচ্ছে
ঘামে ভেজা আপ শান্তিপুর, আমার ঘরের ছেলে
 
ভিড়ে ঠাসা প্ল্যাটফর্মে, ও জীবন, আমি তো শুধু এটুকুই চাই।
 
 


 

বৃক্ষচন্দন

 
আমরা কজন জ্যোৎস্নার হাটে গিয়েছি
চারজন চারবন্ধু আমরা চারজন
সেখানে মজুত মানুষের বেশে যক্ষ এবং কিন্নর
নাচাগানা শেষে তারাই বলল–‘বর চাও’
আমরা চেলাম জ্যোৎস্নার মতো কাউকেই
শুনে হেসে তারা হাতে তুলে দিল—চন্দন
 
সেই চন্দন গায়ে মেখে ঘুরি বাজারে
সবাই ভাবছে—আহো, কী পরম বৈষ্ণব
নমো নমো নমো ম’ ম’ করে ওঠে নন্দন
আসলে সেদিন শরীর গিয়েছে পালটে
মানবশরীর পালটে বৃক্ষ চন্দন
এখন যখন পিছনে ফেরার চান্স নেই
বাজারেই কাটি হাত পা, আহা পিস পিস
কেটে তুলে দিই বউ, দিদি, মা, বোনেদের
ঘষে তুলে ফেলে চামড়া, তাতে দেবতার গন্ধ
‘ডিভাইন ডিও’ নামটি হবে না মন্দ
 
শরীর, সেতো একদিন শেষ হবে ভাই
এমনিতে এই কাঠটি জানোতো কস্টলি
অল্প অল্প কাটছি, দেখি কতদিন চলা যায়  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ