রূপক চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
রূপক চট্টোপাধ্যায়, জন্ম আটের দশকের মধ্যাহ্নে, বাঁকুড়া জেলায় চিরকুন কানালী নামক গ্রামে। জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করলেও লেখালেখির ঝোঁক ছোটোবেলা থেকেই। বর্তমানে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত, রূপকের ইতমধ্যে দ্বিতীয় কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে গীর্বাণ প্রকাশনা থেকে, বইটির নাম ‘নদীর সিম্ফনি’। ওর প্রথম কবিতার বই ‘অবোধের বর্ণমালা জাগে’। আসুন কবিকে পড়ে দেখি…
কবিতা
দুই ফোঁটা জলের দাগ
জনহীন এক হৃদয়ের পিঠে উল্টানো রোদে
ছড়িয়ে দেওয়া ছাতিম ছায়ায় নবজাতকের ঘুম।
অসুখের পাশেই ফুটেছে আরোগ্য নিকেতন
টানটান দিঘির কাজল আঁকা চোখ
পাড়ে এক পায়ে দাঁড়ানো বুড়ি কমলীর হাঁস গোটা চার।
এই পর্যন্ত স্বপ্ন এলে আর
বিছানা ছেড়ে উঠতে চায় না জীবন। দো আঁজলা জীবন।
আত্মটানে দরজা খুলে দাঁড়ায়।
দূরগামী ট্রেন লেগে যায় স্টেশন ব্যস্ততায়,
ইস্পাতের পথে পড়ে থাকে কুচিকুচি রাতের রাগিনী।
শোকের পাশেই সাজানো বাগান
ফুটেছে থোকা থোকা হলুদ বিস্মরণ।
এর পর আবার উঠে পড়ো, ছোলা সেদ্ধ মুড়ি বেঁধে
ছৈ খুলে আরো গভীর বাইতে থাকো ভাটিয়ালি।
দিনমালায়া জ্বল জ্বল করে
দুফোঁটা জলের দাগ!
একটি নদীর সিম্ফনি
বাবার কাছে একটা নদী ছিলো। আমরা জানতাম না।
শুধু পারাবারের কথা মনে পড়ে। ভোরের স্নান সেরে পুণ্যাহম মন্ত্রে তিনি যখন
ঘরে ফিরতেন তাঁর পিছু পিছু শান্তি ফিরে আসতো ময়ূর হয়ে, আমরা জানতাম
না।
তিন ভাই বোনের ভাত আর ভারত সম্বন্ধে ধারণা খুব কম ছিলো। ভারত
বলতে বাবার ঘরে ফের আর মায়ের আড়াই হাজার স্বপ্ন ধার করা জীবন
যাপন।একটা রুটি তিন খন্ড করে খেয়েও
মা কেমন করে বাগান গুছিয়ে দেওয়ায় ছলনায় আমাদের টগর জারুল অথবা
বিশুদ্ধ বনতুলসী করে সাজাতেন বুঝতেই পারিনি।
এখনও নদী আছে, বাগান আছে রুটির ভাঁজে,
জমকালো শহরের পরিবেশ আর ভাতের ওপর
কবোষ্ণ বাষ্প আঁকা দশটা ছটা'র তাড়া আছে।
শুধু তিন ভাই বোনের ভেতর জেগে থাকা সাঁকোগুলো
ক্রমশ কুয়াশা, ক্রমশ অচলায়তন, ক্রমশ আলোকবর্ষ।
আর বাবার পোষমানা নদীগুলো শুকনো শরীর নিয়ে
বুড়ো ঘোড়ার মতো বিবর্ণমুখ। বালির শরীর আঁকা গায়ে!
মায়া
উপনিষদের মায়াকে আমি
মায়া মাহাতো বলেই চিনি।
রুক্ষ চুলের খোঁপায় চাঁদ গুঁজে নিয়ে
সেই যে বেরিয়ে গেল সেগুন জঙ্গলে
আজও গাছে গাছে তার মায়া জন্ম লেগে আছে
এলে দেখিয়ে দিতে পারি!
দুই তীর্থের গান
১.
তুমি আহার বোঝো,
আমি গ্রাসের ভেতর থেকে আজও
গ্রামোফোন রেকর্ডের গোঁগানি শুনি।
দাদু চোখ বন্ধ করে ঝিমোচ্ছেন,
হাঁপানির টান একটু কমেছে।
বৃষ্টি থামলেই বাবা সদর থেকে
নিয়ে আসবেন কচু শাক আর রেশনের চাল।
আমিও চোখ বন্ধ করি। ঝিমুনি আসে
ডুবু ডুবু সূর্যটাই গ্রামোফোন রেকর্ড হয়ে যায় হঠাৎ করে!
২।
প্রণামযোগ্য নদীটির কাছে
গল্প শুনতে আসতাম বিকেল বেলা। সবুজ সংকেতে
সে দূর পাহাড়ের চূড়ায় আমাদের বসিয়ে দিয়ে,
সাংসারিক কাজে কাজেই মোহানা পর্যন্ত পৌঁছে গেল কী করে কে জানে?
রাধা
মাঠে মাঠে দুঃখ তাড়িয়ে ঘরে ফিরছে মেয়ে।
আগে আগে
কুড়ি ত্রিশটা ছাগলের নাচুনী ছায়া
ঘরে ফেরার হাওয়ায় ভেসে ওঠে জারুল
ফুলের রেনু। ধনুক চিহ্নে বক উড়ে যায়।
স্তোত্রপাঠের আড়ালে
আঁধার ঢুকে পড়েছে রাধামাধব মন্দিরে।
অগুর গন্ধে আঁধার কালো ময়ূর
নেচে নেচে নক্ষত্র ছড়াচ্ছে আকাশ মন্ডলে!
দূর নদীতট থেকে শ্রী রাগে বাঁশি বাজে
রাধা বিনোদিনী
ঘরে আসে। ছড়ানো অনাহার থেকে
একটু দূরে মাদুর পেতে বসে
কৃষ্ণ পুরুষ শ্রমের ইটভাটা থেকে ঘরে ফিরেছে কি?
খবর আসে না।
বুকে ছলছল করে কালীদহের জল লাঞ্ছনা!
অনুপ্রবেশ
তোমার স্বপ্নের ভেতর অনধিকার প্রবেশ করেছি।
শাস্তি হিসেবে তুমি আমার
অন্ধত্বটাই কেড়ে নিলে!
এই দৃশ্যমানতা আমায় দূতক্রীড়া থেকে
অষ্টাদশ রণাঙ্গনের দিকে নিয়ে যায়।
এই দৃশ্যমানতা আমায় তৃষ্ণার আলেয়া থেকে
নদীর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
এই দৃশ্যমানতা আমায় পুরুষ থেকে
ক্রমশ পিতার ঝুঁকে পড়া শরীরের আড়ালে দাঁড় করায়!
আমি এতশত না বুঝে
আবার ভ্রূণ জন্ম খুঁজি।
দেহতত্ত্ব খুঁড়ে আবার লালন তুলে আনি
আমার মায়ের মতো একটি গ্রামীণ সন্ধ্যায়!
0 মন্তব্যসমূহ