শ্যামল দেবনাথ'এর কবিতা

 



গুচ্ছ কবিতা

শ্যামল দেবনাথ, জন্ম আশির দশকের প্রথমার্ধে, নদীয়ার শান্তিপুরে।  শৈশব কেটেছে নিচু চাঁপাহাটি পূর্ব বর্ধমানে। বর্তমানে নবদ্বীপে বাস। শূন্য দশকে লেখালেখি শুরু। সঞ্জীব প্রামাণিক সম্পাদিত 'বাঙলাভাষা ' পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ। কবিতার বই 'প্রজাপতিবন্দর ' (প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে)। নিজের সম্পাদিত পত্রিকা 'স্নান '।












কবিতা

মঙ্গলবার

 
আজ মঙ্গলবার। বেসরকারি ছুটির দিন আমার শহরে।
ঝিমোনো দুপুরকে পালকের নীচে গুঁজে
দুলতে দুলতে আড্ডা মারে বাউণ্ডুলে পায়রারা,
সারি সারি দোকান মুখে কুলুপ এঁটে
নিঃশব্দে গল্প করে মালিকের অজান্তে।
সমস্তই দেখে পাগলা ফনু
কেবল বাগদেবীকে বাগে আনতে পথ খুঁজে পায় না।
 
পালবাড়ির বয়স্ক ছাদে এসে বসে নরম বিকেল
কর্তার দুই মেঘমেয়ে শীতরোদের গুঁড়ো
সংগ্রহ করে রাখে থাবার নীচে।
 
আজ ট্রাফিক নেই। আমি মঙ্গলবার।
পায়রা, দোকান, ফনু এবং মেঘমেয়ে
একটা ছুটির দিন।
 
 
 
 

প্রবাহ

 
পৃথিবীর দুপাশে কমলালেবু।
 
মাঝের রেললাইন ধরে ঈশ্বর ও শয়তান
চলে যায় হুহু জঙ্গলে।
 
নিবিড় অন্ধকারে এক উষ্ণ কুয়োর ভেতর
নিজেদের ভিজিয়ে মানুষ হয় তারা।
 
 
 
 
 

প্রজাপতিবন্দর

 
ঠাণ্ডা বৃষ্টিচোখ আচমকা ছড়িয়ে পড়ে
  চোখের আরও ভেতরে
যেন সাপের বুকে আমি
ফ্যাকাশে রাস্তা দৌড়ে উঠে যায়
বন্ধ দোকানের আবছা বারান্দায়
একটু দূরে দোতলার নীল রঙ করা গ্রিল
টপকে এক নদীবৃন্ত টুপিকে ছুঁয়ে ফেলেছি
 
তখন সমস্ত মৃত প্রেম শূন্য ফুঁড়ে
তীক্ষ্ণ বিদ্যুতে ঢুকে যায় গভীরে
 
টিপটিপ বৃষ্টিতে, অন্ধকার ঠেলে ঠেলে ফিরে আসি
তারপর অনেকদিন বন্ধ দরজা খুলে দেখিনি
মেঘে মেঘে সমুদ্র, দুলতে দুলতে অপরিণত তরী
দৃশ্যজগতে প্রণয়বন্দর খুঁজে বেড়ায়
 
 
 
 
 

অলংকার

 
আমি সেই অপুষ্ট সাদা-কালো বেড়ালটি, যে প্রতি মধ্যরাতে নিভন্ত উনুনের চারপাশের গন্ধ
নিয়ে দুধের বাটির ঢাকনা ফেলে অতৃপ্তিতে আবার অন্ধকার। তখন তুমি বাসন গড়ানো শব্দে
ঘুম ভেঙে উটকো আক্রমণে নিজেকে এঁটো হবার হাত থেকে বাঁচাও। এখনও তুমি বুঝলে না
—এই রাত, ঘুম, বেড়াল তোমার নিজেরই অলংকার।
 
 
 
 
 

 জেলেপাড়া

 
যেন সরীসৃপ, এঁকেবেঁকে চলেছে নদী। অন্ধকার বসেছে তার গায়ে। ধবধবে সাদা কাগজে মুদ্রিত
হয়েছে অজস্র অক্ষর। জেলেবউ এখন নিঃসঙ্গ, একা। কেরোসিনের আলো জ্বলছে নৌকোয়।
সরীসৃপ তার পায়ের নীচে। জালের ধাতুবর্ণ রশি হাতে ভাত খোঁজে ছায়ারঙ বেড়াল।
 
ভোর হয়। দরজা খোলে জেলেপাড়া। বাতাসে ছড়ায় আঁশ আঁশ গন্ধ।
 
 
 
 

একটি অসফল প্রেমের কবিতা

 
পুনরায় চাবুকের স্পর্শ
 
পেছনে কিছুটা উঁকি মারতেই
অনেকদিনের পড়ে থাকা নৌকার হাত-পা
ধুলায় মিশে যেতে  যেতেও উজ্জ্বল
 
অখ্যাত জঙ্গলে বেড়ে উঠে
আচমকা হাটে-বাজারে নিজেই বাণী হয়ে
কাগজে মুদ্রিত হওয়ার বাসনায় ফুলচন্দন
এসবই প্রভু যিশুর কৃপা
 
আমি তো আবিষ্কার
প্রবল ঝর্না নিয়ে তাঁতঘর দেখতে এসে
মাকু হয়ে গেছি কখন
 
এখানে পথে পথে
অনেক নিস্তব্ধতার ভিতর
কই মাছের তরতর করে এগিয়ে যাওয়ার ঋতু
নিঃশব্দে ঝরে যায় অবিরত
অসুখের পুঁইফল হাওয়াঘড়ি ফেকলুজন্ম
 
 
 


মনখারাপের কবিতা

 
ঘরের ভিতর ঘর আজ ভীষণ একা
 
বাইরে কামিনী ফুলের হাওয়া রৌদ্র মেখে মেখে
আরও বেশী কামরাঙা
 
আপাতত লক্ষ্মীর দেশে যাওয়া নেই দুশ্চিন্তার
 
ভরাপুরা জীবন নিয়ে সময়ের নাম যেন
‘মেঘে ঢাকা তারা’
 
এই হা হুতাশের দেশে নৌকার নীচে
ঝুরঝুর বালির অন্ধতা
অনেক অনেক দূরে জলের আহ্বান
এই সঙ্গীতের মায়াবী লুকোচুরির আলোয়
নিজেকেও একটু পুড়িয়ে নিচ্ছে একান্ত কুটুম
এই জন্ম থেকে আপাতত পরাজয়ের
স্বাদ সমস্ত শরীরে
 
এরূপ চিন্তার প্রবাহে ভেসে ভেসে
মঙ্গলকাব্যের বন্দরে এখন নাবিক
সাজার সাজা আমাকে জলের মতো
সহজ করে তুলছে




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ