মিরর ছবিটিতে কোনো সাজানো ঘটনা নেই। প্রতিটি ঘটনাই আমার
পারিবারিক ইতিহাসের অংশ— প্রত্যেকটি ঘটনা, কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই। একমাত্র বানানো ব্যাপারটি
হল কথক বা লেখকের (যাঁকে আমরা পর্দায় দেখতে পাই না) অসুস্থতা।লেখকের আত্মিক সংকট বোঝাবার
জন্য, তাঁর সত্তার অবস্থা তুলে ধরার জন্য এই চিত্তাকর্ষক ব্যাপারটির প্রয়োজন ছিল।
তিনি হয়তো মরণশয্যায়, আর সেজন্যই তাঁর স্মৃতিগুলো ফিরে আসছে, ঠিক যেভাবে মৃত্যুর
আগে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ফিরে আসে। এইভাবে ছবিটি গড়ে উঠছে। অর্থাৎ
লেখক নিছক খেয়াল খুশি মতো তাঁর স্মৃতি নিয়ে নির্মম কাটাছেঁড়া করছেন না ; এ হল এক মৃত্যুপথযাত্রীর স্মৃতিবাহিত সেইসব ঘটনা,
যা বিবেকের ওপর ভারী হয়ে চেপে বসে। ছবির একমাত্র সাজানো ঘটনাটি তাই হয়ে উঠছে
যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একান্ত সত্য স্মৃতিগুলো। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। এইভাবে সৃষ্টি
করা, একান্ত নিজের জগৎকে এইভাবে বানিয়ে তোলা— এর মধ্যে সত্যতা কী আছে? আমি বলব, হ্যাঁ
অবশ্যই সত্য। এ হল স্মৃতির প্রিজমের ভেতর দিয়ে প্রতিসারিত সত্য। ধরা যাক আমার শৈশবের
বাড়িটি, যা আপনি ছবিতে দেখছেন। ওটি একটি তৈরি করা সেট। অনেক বছর আগে যেখানে আমাদের
বাড়িটি ছিল, ওটি তৈরি করা হয়েছিল ঠিক সেই জায়গায়। কিছুই ছিল না, ভিতের অংশও ছিল
না। যেখানে বাড়িটি দাঁড়িয়েছিল সেইখানে ছিল শুধু একটা গর্ত। ঠিক ওইখানটায় বাড়িটি
ফের তৈরি করা হয়েছিল, পুরোনো ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে। এটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ
ব্যাপার; সেটা এজন্যে নয় যে আমি এক ধরনের বাস্তববাদী হবার চেষ্টা করেছি। আসলে ছবির
বিষয়টির প্রতি আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী নির্ভর করছে এইভাবে পুনর্নির্মাণের ওপর।
বাড়িটা অন্যরকম দেখালে আমার ভেতরে একটা সংকট দেখা দিত। হ্যাঁ, গাছগুলো অবশ্য খুব বেড়ে
গিয়েছিল : বড্ড ঝোপঝাড় গজিয়ে গিয়েছিল। আমাদের অনেক কাটাছাটা করতে হয়। কিন্তু সবকিছু
হয়ে যাবার পর আমি যখন আমার মাকে নিয়ে এলাম— এই ছবিতে মাকে অনেকগুলো দৃশ্যে দেখা যাবে—
মা এতই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে আমি তক্ষুনি বুঝতে পারলাম ঠিক জিনিসটি তৈরি হয়েছে।
কেউ ভাবতে পারেন : এত খুঁটিয়ে অতীতকে ফের বানিয়ে তোলার দরকার কি আছে ? অথবা, আরও
খোলসা করে বললে, এ তো ঠিক অতীত নয়, এ হল আমি সেই অতীতকে যেভাবে ভাবছি সেটা। না, আমি
যে ঠিক আমার নিজের মনগড়া স্মৃতির একটি আকার খোঁজার চেষ্টা করেছি তা নয়। বরং আমি চেষ্টা
করেছি অতীতে ঠিক যেমনটি ছিল সেইরকম করে গড়ে তুলতে ; বলা যেতে পারে, আমার স্মৃতিতে
ঠিক যে অতীতটি ধরা আছে, তার একটি হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করতে চেষ্টা করেছি। এবং এর পরিণাম
হল খুব অদ্ভুত। আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা একটা সম্পূর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা হয়ে উঠল। আমি
এমন একটা ছবি বানালাম যার একটিও দৃশ্য বা ঘটনা দর্শক টানার জন্য, তার মনোযোগ ধরে রাখার
জন্য, কোনো কিছু ব্যাখ্যা করার জন্য তৈরি হয়নি। এ হল আমাদের পরিবার ও আমার জীবন নিয়ে
সত্যিকারের স্মৃতির পুনরুদ্ধার। এবং এটি একটি অত্যন্ত ব্যক্তিগত কাহিনি হওয়া সত্ত্বেও,
কিংবা হয়তো সেজন্যই, পরে আমি দর্শকদের কাছ থেকে অসংখ্য চিঠি পেয়েছি যেখানে তাঁরা
একটি সাংকেতিক প্রশ্ন করেছেন : 'আপনি আমার জীবন জেনে ফেললেন কী করে ?
আমি মনে করি না যে দর্শককে আকর্ষণ করা ও ধরে রাখা আমার
কাজ ; কারণ এর অর্থ হবে আমি তাদের বুদ্ধিকে ছোটো করে দেখছি। আমি মনে করি না দর্শকেরা
বোকার দল। কিন্তু আমি প্রায়শই এটাও
ভাবি যে পৃথিবীর কোনো পরিচালক ১৫ কোপেকও লগ্নী করতে চাইবেন না, যদি আমি তাদের বলি যে
আমি শিল্প করতে এসেছি। সেজন্য আমি প্রতিটি
ছবি তৈরিতেই সম্পূর্ণ শক্তি ও অধ্যবসায় ঢেলে দিই। আমি আমার সেরা জিনিসটা দেবার চেষ্টা
করি, তা নাহলে আমি হয়তো আর কখনো ছবি করার সুযোগই পাব না। আমি মনে করি যে নিজের আদর্শের
সঙ্গে সমঝোতা না করে আমি আমার মতো করে দর্শকদের আকর্ষণ করতে পেরেছি। শেষপর্যন্ত সেটাই
হল আসল কথা। আমি আকাশ থেকে পড়া ইন্টেলেকচুয়াল টাইপ নই, অন্য গ্রহ থেকেও আসিনি। বরং
এর ঠিক উলটোটাই : আমি এই বিশ্ব ও মানুষের সঙ্গে গভীর বন্ধন অনুভব করি। এক কথায় বললে,
আমি যতখানি বুদ্ধিমান তার থেকে বেশি বা কম হিসেবে প্রতিভাত হতে চাই না। আমি দর্শকের
জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি, শুধু আমার কাজটা আলাদা । দর্শকের থেকে আমার উদ্দেশ্য ভিন্ন।
সবাই আমাকে বুঝুক, এই ব্যাপারটা আমার কাছে
খুব অপরিহার্য নয়। বরং সবাই আমাকে বুঝবে না, এই ব্যাপারটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সিনেমা যদি শিল্প হয়— এবং আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আমরা একমত- তাহলে এটা ভুলে গেলে
চলবে না যে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম কিন্তু পণ্য নয়। শিল্প তখনই সর্বোত্তম হয় যখন তা একটি
যুগের আদর্শ ফুটিয়ে তোলে, সৃজনশীলতার দিক থেকেও এবং যে সংস্কৃতির ভেতর জন্ম নিচ্ছে
তার দিক থেকেও। আমরা যে সময়ে বাস করি সেই সময়ের আদর্শগুলোয় রূপদান করে একটি মাস্টারপিস।
আদর্শ কখনো চটজলদি সহজলভ্য করে তোলা যায় না। তার কাছে পৌঁছোতে গেলে চৈতন্যের দিক থেকেও
সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে হবে। জনগণের চেতনার মান ও শিল্পে প্রতিভাত আদর্শের মাঝে যে দ্বান্দ্বিক
টানাপোড়েন, সেটা যদি সম্পূর্ণ উবে যায় তাহলে বুঝতে হবে শিল্প তার উপযোগিতা হারিয়েছে।
দুর্ভাগ্যক্রমে খুব কম ছবিই নিছক বিনোদনের ওপরে উঠতে পারে। নিখাদ, সহজ ও সংযমী স্পর্শের
জন্যই দোভঝেঙ্কো ও ব্রেসঁদের ছবি আমার কাছে সম্পদের মতো। এই গুণ অর্জন করার প্রয়াস
চালাতেই হবে শিল্পকে। আর চাই বিশ্বাস। কোনো সৃজনশীল ভাবনা দর্শকের চেতনাকে স্পর্শ করার
পূর্বশর্ত হল স্রষ্টার দর্শকের প্রতি আস্থা। একই মাটিতে দাঁড়িয়ে দুজনের কথোপকথন জরুরি।
অন্য পথ নেই। শিল্পীর কাছে যতই স্পষ্ট হোক
না কেন কোনো চিন্তা, সেটা জোর করে দর্শকের মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করা সম্পূর্ণ অর্থহীন।
কিন্তু দর্শকের নীতিবোধের প্রতি সম্মান রেখেও কখনোই আধুনিক শিল্পসম্মত ছবি বানাব বলে
নিজের কর্তব্যের সঙ্গে সমঝোতা করা উচিত নয়। দর্শকের
নিম্নমুখী রুচির দ্বারা নিজেকে চালিত হতে দেওয়া চলবে না। সাহিত্যাশ্রয়ী নাটুকে
নির্মাণে আমার কোনো আস্থা নেই। এর সঙ্গে সিনেমাশিল্পের নিজস্ব নাট্যকৃতির কোনো সম্পর্ক
নেই। এখনকার বেশিরভাগ ছবিই দর্শকের কাছে ঘটনাক্রিয়া, অর্থাৎ ছবির গল্পটি ঘিরে পরিস্থিতি
ব্যাখ্যা করা ছাড়া আর কিছুই করে না। কিন্তু ছবিতে কিছু ব্যাখ্যার দরকার নেই, যা দরকার
তা হল সরাসরি আবেগের কাছে পৌঁছোনো। আবেগকে চাগিয়ে তুলতে পারলে সে নিজে নিজেই বুদ্ধিকে
এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি এডিটিং-এর এমন একটি পদ্ধতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছি যা দিয়ে
গল্পের নিজস্ব যুক্তি কাঠামোর বদলে একটি সম্পূর্ণ আত্মগত যুক্তিশৃঙ্খল দিয়ে দর্শককে
আচ্ছন্ন করা যাবে, যা গড়ে উঠবে ভাবনা, স্বপ্ন আর স্মৃতি দিয়ে। আমি এমন একটি ফর্মের
সন্ধান করছি যা মানুষের সত্তার বাস্তব অবস্থার ভেতর থেকে জন্ম নেয় ; অর্থাৎ কিনা সেইসব
কারণগুলো, যা মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে। মনের সত্য ফুটিয়ে তোলার পূর্বশর্ত সেটাই।
আমার ছবিতে গল্প খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার ছবির আসল তাৎপর্য কখনোই প্লটের সাহায্যে
ব্যাখ্যা করা যাবে না। অহেতুক চিত্তবিক্ষেপ ছাড়াই যা কিছু তাৎপর্যময় তা বলার চেষ্টা
করি আমি। এমন কিছু জিনিস দেখাবার চেষ্টা করি, যা সর্বদা নিছক যুক্তিশৃঙ্খলে বাঁধা নয়।
আমাদের মনের গভীরে যে ভাবনার তরঙ্গ ওঠে, সেই তরঙ্গই জুড়ে দেয় ওই আপাতবিচ্ছিন্ন জিনিসগুলোকে।
এটার মানে কী ? ওটার মানে কী ?—– আমার ছবি দেখে এমন প্রশ্ন অনেকেই করেন। ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
একজন শিল্পী তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন না। আমার নিজের কাজ নিয়ে কোনো
গভীর সুবিজ্ঞ ধারণা লালন করি না আমি। আমার ছবিতে প্রতীকগুলো কী বলতে চায়, সে ব্যাপারে
সত্যিই আমার কোনো ধারণা নেই। আমি কেবলমাত্র যে জিনিসটি করতে চাই তা হল কিছু আবেগের
জন্ম দেওয়া। যে অনুভবগুলো জেগে ওঠে, তা একান্তভাবেই দর্শকের ভেতর থেকে সাড়া দেওয়ার
ধরনের ওপর নির্ভর করে। আমার ছবির মধ্যে লুকোনো অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। কিন্তু
একজন ছবি বানাবেন, আবার একই সঙ্গে নিজের ভাবনা লুকোবার চেষ্টা করবেন— এই ব্যাপারটা
কেমন অদ্ভুত না? আমার ছবিতে ইমেজগুলো যা, তার থেকে বেশি তারা আর কিছুই বলে না।
0 মন্তব্যসমূহ