প্রশান্ত দেবনাথ'এর কবিতা

 

গুচ্ছ কবিতা 

প্রশান্ত দেবনাথ

জন্ম ১৯৬৮। কবি শঙ্খ ঘোষ’এর শ্রেষ্ঠ কবিতা পড়ে ভেতরে বেজে ওঠা ও তারপর লেখালেখির শুরু। ইতিমধ্যে অসংখ্য ছোটো বড়ো কাগজে লেখার পাশাপাশি কবির দুটি কবিতার বই রয়েছে। ‘মেঘ, তুমি যাও’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৩, কালেক্টিভ পাবলিকেশন, মূল্য: ১৫ টাকা। দ্বিতীয় প্রকাশ: ২০০৯, উপমহাদেশ প্রকাশনা, মূল্য: ২০টাকা)। ‘অসুখ সেরে গেলে’ (প্রথম প্রকাশক: সাম্পান প্রকাশনা, ২০০৪, মূল্য: ১০ টাকা)।সবার অলক্ষে কবিতা-চর্চা করে চলেছেন এই কবি, ভ্রমণ ভালোবাসেন, ভালোবাসেন রবীন্দ্র সংগীত। পাঠকের জন্য এই পর্বে থাকল কবির প্রকাশিত বই দুটি থেকে একগুচ্ছ কবিতা।




মেঘ, তুমি যাও

 
গতকাল আমি বড্ড অগোছালো ছিলাম
দক্ষিণের কবরগুলোতে জল দিতে ভুলে গেছি
আমার দু’চোখে নেমে আসছে বিষণ্ণ গোধূলি
 
মেঘ, তুমি যাও
আজ আর কবিতা লেখা হবে না
 

 
 
 

পুরুষ বোঝে না

 
এখন ব্যাধের মতো এই রাত্রি
বাঁধ ভেঙে ছুটে যাচ্ছে ঘোড়া
 
জ্যোৎস্নায় কেঁপে উঠছে তার নীল শরীর
 
শিয়াল কুকুরে কি খেয়ে ফেলেছে?
না-এখনো বেঁচে আছে যাকে ফেলে এসেছে
একটু আগে ব্রিজের নিচে গোপনে
 
অন্ধকারে জ্বলে ওঠে এই প্রশ্ন
পুরুষ বোঝে না এতসব, তর্জনী তোলে…
 
ব্যাধের মতন এই রাতে
যুবতীর ভিতর ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে আগুন
 
 




ফেরার সময়

 
সেদিন হই-হুল্লার মধ্যেই আমরা জৈন্তী পৌঁছলাম
শালবনের আড়ালে তখন চাঁদ আর লুকোচুরি
 
আমাদের একজন চলে যায় অন্ধকার কুড়োতে
একজন মাতাল ঘুমিয়ে পড়ে তার নিজস্ব দুঃখের ভিতর
 
আমি খাদ পেরিয়ে পাহাড়ি টিলায়
রাত্রির চুলের ভিতর নাক মুখ ডুবিয়ে…
 
ফেরার সময় প্রত্যেকের মুখের রেখায়
আমি বিষাদের চিহ্ন দেখেছি, অথচ সেদিন
হই-হুল্লার মধ্যেই জৈন্তী পৌঁছলাম আমরা
 




 

স্বপ্ন

 
দাওয়ায় লণ্ঠনের নিবু-নিবু আলো
 
এক অশীতিপর বৃদ্ধ দুর্ভিক্ষের গল্প বলছেন
শকুনের পাখার মতো অন্ধকার ঘিরে আছে
 
আমার অনুভবের ঘরে সারি-সারি
মাটির কলস, কলসভর্তি নীল জল…
 
রাত্রির জানলা দিয়ে দেখলাম
মৃত্যু ফিরে গেল আহত শৃগালের মতো
 
 
 



আমার এক বন্ধুকে

 
কৈশোরে এই খালের ধারে আমরা ক’জন
খুব আড্ডা জমাতাম বিকেলে
 
তখন চোখে চোখ রাখলে স্বর্গের জন্ম হত
আমাদের গল্পের মাঝখানে অরণ্যের শিকড় থেকে
ধীর পায়ে উঠে আসত হেমন্তের রাত্রি
 
তেরো বছর পর, আজও আমরা কফি হাউসে
মুখোমুখি বসি, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঝড় তুলি
 
কথায় কথা ঢুকে জ্বলে ওঠে আগুন
আমাদের দুঁহাতে আজ বিষাক্ত নখ
আমাদের দু’চোখ আজ ভীষণ অবিশ্বাসী
 
সেইসব দিনগুলি কাকেরা খেয়ে ফেলছে…
 
 

 


এপিটাফ

 
সভ্যতার গুহায় রান্না হচ্ছে আমাদের জীবন
 
ভারতবর্ষ বুকে নিয়ে আমি থরো-থরো কাঁপি
 
যীশুর মতো হাত তুলি, কোথায় নিরাময়?
 
চোখের পাতায় নিরুক্ত প্রহর থেমে থাকে
 
এসব মুহুর্তে উপবাসী চিতা জল চায়
 
আমি ধর্ম জানি প্রেম জানি বোধিবৃক্ষ ও পতন জানি…
 
দেখো, আমি ঠিক খুঁজে নেব বিশল্যকরণী
 
 

 


জৈন্তী

 
চুল খোলা, গলায় পাউডার
কালো মেয়েটি কুড়োচ্ছে শীতের ঝরা পাতা
 
তার কোমর জড়িয়ে আছে ডুয়ার্সের বাতাস
 
আচমকা ঝড় উঠল ঝাউয়ের গলিতে
নৈঃশব্দ্যের বুকে খসে পড়ল প্রত্ন শিলা
 
জঙ্গলময় বটের ঝুড়ির মতো সন্ধ্যা
 
একটু পরেই এখানে দেখা যাবে
বাঘের চেয়ে ভয়ংকর কিছু মানুষ…
 
 

 


আমাদের বসবাস

 
এই পথ চলে গেছে পূর্ণিমার দিকে
ওই পথ কৃষ্ণপক্ষ হয়ে যে কোথায়
ঠিক তাঁর মাঝখানেই বসবাস করি
 
মুখোশের থেকে বের হয়ে ডেকে বলি ;
আমি একা ভাঙি? একা ছড়াই পাথর?
তুমি কিসে কম, আমি তোমাদের জানি
 
এইসব এলোমেলো কথার ভিতর
নামে কড়াতের মতো গ্রীষ্মের দুপুর
 
এবং সন্ধ্যায় আর পাখিরা ফেরে না…
 
 
 

 

তোমার জন্যই

 
কবি নই আমি যিশু নই
সকলেই জানে আমি জন্মভিখারি
শুধু তোমার জন্য নৌকা ভাসিয়েছি অথৈ জলে
এই যে আমি ক্ষয়ে ক্ষয়ে…
একদিন হয়ত গলেই যাব
জলের ভিতর জল হয়ে মিশে যাব
 
শুধু তোমার জন্য বালির পাহার ভেঙে
এই তো আমার হেঁটে যাওয়া
শুধু তোমার জন্যই পথে আমি ঘর বেঁধেছি
শুধু তোমার জন্যই এত কিছু…

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
ভালো লেখা