অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়'এর কবিতা



দ্বন্দ্ব লিখিনি আমি

প্রকাশক :         হাওয়াকল
প্রকাশ কাল :     অক্টোবর ২০২০
মূল্য :            ১৭৫ টাকা

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

                  শূণ্য পরবর্তী সময়ের কবি অভিনন্দন’এর জন্ম ১৯৮৬ সালে। লেখালেখির শুরু ২০০৯’এর দিকে। কবিতা লেখার পাশাপাশি সম্পাদিত পত্রিকা ‘সলতেবাড়ি’। ইতিমধ্যে কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘সিলভার লাইনিং’, ‘লাভ ক্যাপুচিনো’(যৌথ), ‘এ জীবন ক্রিকেট-লিখিত’, ‘পর্ণগ্রাফিত্তি’, ‘দ্বন্দ্ব লিখিনি আমি’। এই পর্বে কবির পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ থেকে কিছু কবিতা পাঠকের উদ্দ্যেশ্যে রাখা হলো।


 

 

লড়াই


তুমুল যোনির মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছি ঋজু গান
নিজের খেয়ালে বাজে পিয়ানোর সাদা কালো দাঁতে
প্রতিটি তালের গুণ দ্রুত হয় লয়ের আঘাতে
রসের সমুদ্র ধরে ভেসে যায় মৃদু সাম্পান

ঢেউ আর কাকে বলি? সে নিজেই নিভৃতচারিণী
পিঠের প্রতিটি ভাঁজে ফুটে ওঠে আঁচড়ের সুধা
রাত পারাপার শেষে আগুনের মতো আরো ক্ষুধা
জেগে থাকে লিঙ্গমূলে,যোনিটি তখনো থাকে ঋণী

যেন কতকাল আগে ভাসিয়েছে নাভিটি, নদীতে
স্রোত এসে নিয়ে গেছে যাবতীয় উপাসনা, কাম
গোপন সারথী যেন, নেমে আসে রতিমধ্যযাম
তাকেই সূচনা করে অবশেষে ভেঙে, শুষে নিতে

আগুন নিভেছে তবু ধিকিধিকি জ্বলে আছে ছাই
এ আসলে কিছু নয়, প্রকৃতির আদিম লড়াই
 
 

মাপ


জুতোটি পালিয়ে গেছে। পালিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে
ফেলে রেখে গেছে ধাঁধা, আমাদের বোধের অতীত।
আবহ জটিল শুধু অলিখিত ফলকের গায়ে
বরফ জমেছে, যেন অসময়ে এসে পড়া শীত

চোখের ভেতরে চোখ, তা-ও সেই উধাও কাহিনী
ভীষণ ভাবাচ্ছে আর প্রশ্ন তুলে দিয়ে যাচ্ছে এই-
নিজের পায়ের কাছে যে পথিক আজীবন ঋণী
তার পথশ্রম দিয়ে জুতোটি নিষেধ ভাঙবেই?

ভ্রমণ এমন ছিল ফুরিয়ে গেলেও তার রেশ
থেকে গেছে বহুদিন। আবার জড়াতে চেয়ে ফিতে
ম্যাপের কিনার ধরে হেঁটে গেছি শুরু থেকে শেষ
কতটা পাথর ছিল জুতোর ভেতর, বুঝে নিতে

সে হিসেব অন্ধকার। গ্রহতে ফেরাবো তাকে,সরো
প্রতিটি পায়ের মাপ স্মৃতিহীনতার চেয়ে বড়

 
 

ব্যাপারী


শপিং মলের আলো আমাদের গ্রহণীয়, চেনা
সারি সারি কাটা দেহ ঝুলে আছে হ্যাঙারের থেকে
সেইসব ঠাণ্ডা অতীত হারানো মাথার দামে কেনা
ট্রলি ঠেলে গেছে মন, আত্মাটুকু বিঁধেছে পেরেকে

যারা যারা আসে যায় সকলেই আলুথালু দামে
নিজের কফিন কেনে সুলভ এবং বেশী ছাড়ে
যে করেছে মাধুকরী কেটে যাওয়া ঘুড়িটির নামে
সে কীভাবে সব ছেড়ে লাইনে মিলিয়ে যেতে পারে?

সিঁড়িটুকু উঠে যায়, রেখে যায় ভেঙে পড়া চোখ
এমন শীতের দেশে কে আর আহত হতে চায়?
মশালা কফির কাপে উড়ে এসে পড়েছে পালক
ছায়া ফেলে গেছে কেউ ট্রায়াল রুমের আয়নায়

আমাকে প্রসব করে প্রবাদে হারিয়ে গেছে নারী
আগামী শপিং মলে আমি হবো আদার ব্যাপারী
 
 

বেদানা


বেদানার কোয়াটুকু রেখে আসি স্তনের চূড়ায়
কে তাতে কামড় দেবে? কে তার লাল শাঁস চিরে
বাজুবন্ধ খুলে দিয়ে ক্রমশ আদিম হতে চায়?
ছিলার টানের ধ্বনি লেগে থাকে ছুটে যাওয়া তিরে

ব্যাধ,তার শিকারের অন্ধকার লালাটুকু ঘষে
স্তন বেয়ে উঠে আসে যেখানে লাভার পাশে নুড়ি
বিছিয়ে রয়েছে ঘন, অতিস্পর্শকাতরতা দোষে,
চূড়ার প্রতিটি ভাঁজ ধারালো জিভের মতো ছুরি

ফালাফালা করে দেয়, শরীর ছাপিয়ে ওঠে জল।
সে জলের নিহিতার্থ পারদে মাপিনি কোনোদিন
শুধু তার মায়াটুকু খিদের মুখেই সম্বল
যেভাবে নরম স্নায়ু লিঙ্গ নামে পরিচিত, ক্ষীণ

ওঠে তাপ, ওঠে বাষ্প, আগুনের ইতিহাস জানা
আদিম ফলের মানে খোসাহীন ছাড়ানো বেদানা

 
 

কামড়


দেখেছি যোনি দংশন, শুনেছি বিষম কোনো দেহ
রঙ্গন ছড়ানো পথে তারাগুলি নরম,বিদেহ
গন্ধপুষ্প লেখা হাতে নেশার অধিক কিছু বেশী
ছেয়ে আসে ঘন ধোঁয়া। উহারা চাঁদের প্রতিবেশী

যা আছে উদীয়মান, কুচো ঘাস লতাপাতা ঢাকা
গভীর রহস্য ঘেরা, সোঁদা এক গন্ধ নিয়ে থাকা
প্রাচীন অরণ্য কোনো। মুক্তিকামী, কামজর্জর
উষ্ণতা মৌন যেখানে, সেখানেই নেমেছে কামড়

কামড়ের দাগ প্রভু কোথায় লুকোবো আর বলো
এমন মায়াবী ক্ষতে নত হয়ে যায় রতিজলও
ক্ষণ বুঝে ভেঙে পড়ে, ভরে ওঠে জোয়ারের খাঁড়ি
চাঁদের প্রবল টানে না ভেসে কীভাবে আর পারি?

ভেসে যাই এতখানি, দেহবিম্ব যতদূরে শেষ
প্রতিটি কামড় মানে পুনরায় খাঁড়িতে প্রবেশ
 
 

অশরীরী


লেখা তো বিকট ছায়া, অশরীরী ডানা মেলে রাখে
ভুতুড়ে রূপক যত এলোমেলো করে দেয় ধ্বনি
ঘুম নেই।অন্ধকার।আলোকে আড়ালে কেউ ডাকে
শব্দ মৃতপ্রায় জাতি, সাদা পাতা পরিত্যক্ত খনি

তার পাশে জেগে থাকি, পাহারা দেওয়াই জানি কাজ
যেভাবে চিতার পাশে জেগে থাকে নাতিদীর্ঘ ডোম
কোথাও আগুন নেই, ধোঁয়াতেই ঢেকেছে সমাজ
তার নিচে অলঙ্কার। ছন্দজল গভীর, নরম

প্রসাধন কাকে বলে? কীভাবে সাজাবো মোহ, ভাবি
কার মুখে ছাই দেবো? কার মুখে গুঁজে দেবো বালি?
প্রতিটি লেখার পরে ফুটে ওঠে না লেখার দাবি
প্রতিটি লাইন শেষে ফুরিয়ে যেতেই চায় কালি

ফুরোয় অনেক কিছু, তবু সেই ছায়াটিকে টানি
লেখা এক অশরীরী, শব্দ এক অমোঘ জবানি

 
 

রাস্তা


কিছুদূর একা হেঁটে মনে হয় পাশে কেউ থাক
যতটুকু পারা যায় তাকেই সজীব করে রাখি
এমন নীরব দিনে কেউ এসে পালক ছড়াক
জীবনের কাছাকাছি ফিরে যাক শরাহত পাখি

গাছে গাছে ফুল আসে পাতাটির আড়ালে আড়ালে
আদরের ছায়াটুকু পড়ে থাকে হিতাহিত ভ্রমে
ফুরিয়ে গিয়েছে ঘ্রাণ এ যাবৎ ফেলে আসা কালে
যেভাবে ফুরিয়ে যায় ছড়ানো বিষাদ ক্রমে ক্রমে

কাকে আর ভুল বলি? তা আসলে ব্যথার প্রাচীর
উঁচুনিচু কুরুশের বুনে দেওয়া নরম স্তবক 
যেভাবে হাতের মাঝে রেখাগুলি অবিরাম স্থির
মনে হয় আমি সেই আলোতে মিলিয়ে যাওয়া লোক

কিছুই থাকেনা শ্লেটে, শুধুমাত্র লিখে রাখি ধুলো
কিছুদূর একা হেঁটে মুছে ফেলি বাকি রেখাগুলো

 
 
 

ছায়া


কাচে যার ছায়া পড়ে সে আমার আত্মলিপি, মদ
প্রবল মেঘের থেকে উঠে এসে ছড়ায় বিধান
ঢেকে রাখে পরাভব, ফিকে হয়ে যাওয়া প্রচ্ছদ
যা কিছু ঠিকানাহীন সেখানে পাঠায় ছেঁড়া গান

তার যত স্বরধ্বনি, বাতাসে ভাসায় উপহাসি
সে কোনো লাঙল নাকি স্বপ্নে পাওয়া লোহার গীটার?
আমি তো বুঝিনি ঠিক, শুধু তার নোটেশনে ভাসি
ভাবি এই ক্ষয়ে যাওয়া মৃত প্রতিবিম্বটুকু কার?

ভাবার অছিলা থেকে নেমে আসে দীর্ঘতম রোদ
তাকে ধরে রাখে এক অসহায় সফেদ বেলুন
যে বিষাদ উপদ্রুত, সেখানে কে বাজায় সরোদ?
ভাতের থালার পাশে জেগে থাকে কান্না-ক্ষোভ-নুন

অনুসরণের দায়ে নিহত আমার ছায়াটিকে
হত্যা করো পুনরায় বাঁচিয়ে তোলার জাদু শিখে
 
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

ছায়ারোদ বলেছেন…
শব্দ ও ছন্দ নিয়ে রীতিমতো খেলা করেছ দাদা। সবগুলিই দুর্দান্ত।
Robin Basu বলেছেন…
সুন্দর কবিতা