পঙক্তিগুলো ধরো

 






পঙক্তিগুলো ধরো

পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত

             জন্ম -৩রা ডিসেম্বর ১৯৪৯ সাল, অধুনা বাংলাদেশের রংপুরে। পরবর্তী কালে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন ধুপগুড়ি শহরে। সুদর্শণ শান্ত চেহারার আদ্যপ্রান্ত কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত’র লেখায় মায়াবী রহস্য পাঠককে নিয়ে যায় এক অন্য জগতে। কবিতার মতোই তার গদ্য পড়লে মনে হয় যেন লেখকের মুখোমুখি বসে আছি। আর তার একান্ত ভাবনার রেশ পাঠকের মাথার ভেতর ঢুকে যায় অনায়াসে।


পঙক্তিগুলো ধরো


আমার একটু বলা দরকার, হেঁয়ালি ভরা কাহিনীর সমাপ্তিটুকুই বা কেমন এই বলার মধ্যে যে সব কিছুই থাকবে না, তবে আমার যুদ্ধক্ষেত্রটি আলাদা রকমের কোনকিছুর ফয়সালা হোক তা চাইনি, ভেবেছি খারাপটাকে ঢেকে রাখবো, ঠিক আগের রাত্রে যা হয়েছিল। কাছের একটি তারা খসলে যা হয় কিছুদূর গিয়ে তার আলো নিভে যায়, অর্থাৎ ঠিক এমনই সময়ে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যায়, দারুণ উদবিগ্ন হয়ে পরি। আসলে তারাখসাতো কোনো কমেডির সহধর্মিনী নয়, অভিক্ষেপও নয়। সেখানে গাঢ়তর সৃষ্টির রহস্য যা আমি ধরতে পারিনি, শাসন অলক্ষিত, তার রসায়ন আমার জানা নেই। কল্পনার মধ্যে আছি। অস্তিত্বের আখ্যানে।

এই আখ্যানের পথে পথে জাদুবিদ্যার ক্ষণস্থায়ীত্বকে আমি ঢেকে ফেলবো। জীবন ও মৃত্যু এই সম্পর্কের সত্য সন্ধান আমার কাজ নয়, মাথার খুলির ভিতর যে রহস্য লুকিয়ে আছে তাকে তো সন্ধান করেছি বারবার। দার্শনিক ব্যাখ্যানে কি কাজ! ভাবনারা এই রকমই, তাদের বহুবিধ চালাকির আত্মপ্রকাশ, নানাভাবে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাই, কিছুটা এগুতেই নতুন রহস্যের হেঁয়ালি ভরা চাঁদ ডুবে যায় কলাগাছের ফাঁক দিয়ে, কোথায় কে জানে। দুশ্চিন্তার শুরু এখানেই।

 

‘দুজনের পরিণতি মনে ভেবে দু-চোখ আনত

হয়েছিল অশ্রুভারে, তারপরে রাত্রি এলো নেমে,

প্রেমের প্রহর সে-তো প্রত্যাশায় অন্তর উদ্যত

তরুণ-হৃদয়ে স্বপ্ন, আশীর্বাদ প্রথমার প্রেমে।

দায়ীতের মধুঝরা কণ্ঠস্বর শুনেছে কেমন

রূপবতী জুলিয়েট, বিদায়ের ম্লান সম্ভাষণে

স্নিগ্ধ স্বরে কেন তাকে ফিরে ফিরে ডেকেছে এমন?’

 

ডাক, সেতো সর্বগ্রাসী অগ্নিবলয়, আবেগে যার ছন্দ লেলিহান হয়ে ওঠে। আমি ধরতে পারি না, কিন্তু প্রেমের যতখানি জাগরণ ঘুমলোক তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। ঘুরে বেড়াই এ বাস থেকে ও বাস, এ শহর থেকে অন্য শহরে, রঙিন রুপলির পিছু পিছু, টনটনিয়ে উঠছে রোমান্টিক হ্যামলেট ওফেলিয়ার প্রেম। কৈশোরের হাটে বাজারে ড্যান্স বিড়ি কোম্পানির ড্যান্স, মাইকে হিন্দি গান বাজছে, তালে তালে নাচছে দৃপ্ত পুরুষরমনী আর আমি তাদের পিছে পিছে, ব্যর্থতার পরিণতি কি দেখা গিয়েছিল তখনি! স্মৃতিময় সেই রোমিও জুলিয়েট আহা, ভাবলে কেমন লাগে। পাঠক ভাবতে পারেন হেঁয়ালির কারণটা কি, এতো হেঁয়ালি। এইভাবে সমালোচিত হতে পারি। আমি তো লাটের বাট নই, যা লিখবো তাই পড়তে হবে পাঠককে, পড়ুন তো ভালো, না পড়লেও আমার কিছু যায় আসে না। না পড়ার মন্তব্য থাকবে না। এতে আপনার লাভ নেই। আসলে আপনাকে উদার হতেই হবে। ব্যান্ডের আগাপাশতলাই কি আর আচার-পরায়ন, না না তা কেন! বেনোজল, তবু আমরা সেই সব চিৎকার, প্রেমের আকুতি, মানবতান্ত্রিক প্রেম, কল্যাণমৈত্রীর কথাগুলো তো মন দিয়ে শুনি, সুরে লাগুক চাই না লাগুক, সেরকম আমার ফকিরিতে আপনার আপত্তি কেন, আমি কখনো হিন্দু সাধক হতে পারি যদিও আমি তা নই, হতে পারি বৈরাগী, আউল-বাউল। হতে পারি গীতাঞ্জলির  বিশ্বমুখি চেতনার গান, হতেই পারি। আমি যে ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত তাকে ভূগোলে ডুয়ার্স বলা হয়েছে, ‘প্রেমে পরানে গানে গন্ধে আলোকে পুলোকে প্লাবিত করিয়া নিখিল দুলোকে ভুলোকে তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝড়িয়া’। এই আমি, রবীন্দ্রনাথের আমি, ডুয়ার্সের আমি, তরাই’এর আমি, উত্তরবাংলার আমি, পশ্চিমবাংলার আমি, ভারতবর্ষের আমি, পৃথিবীর আমি। কাব্যে মুক্তি, এই বিশ্বাসের আমি। তাহলে কেন আমি ব্রাত্য, কেন আমার লেখা আপনারা পড়বেন না, আমার বই নেই, তা’বলে কি পত্রপত্রিকায় তো কতই লিখছি, পড়ুন। আমার বই না থাকলে কি আমার পাঠক নেই! ‘মাঝে মাঝে ভেদচিহ্ন আছে যত যার সে চাহে করিতে মগ্ন লুপ্ত একাকার। মধ্যদিনে দগ্ধ দেহে ঝাঁপ দিয়ে নীরে মা বলে সে ডেকে ওঠে দগ্ধ তটিনীরে’।

প্রবৃত্তির এই উৎসার, বাবা বলতেন সবার মধ্যেই ভালো আছে, ধরো তাকে, মা বলেন – গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠো, এই সত্যের শাস্ত্রান্তগত আছি বলেই যা খুশি লিখতে পারি, যা যা আপনার ভালো লাগছে না ছেটে ফেলুন ধারালো অস্ত্র দিয়ে, আমি উদার। আমি বাতাসের চেয়েও উদার, আলোর চেয়েও এমনকি আমার মায়ের চেয়েও। একটু বেশি বেশি ঠেকছে কথাগুলো তাই না! সত্যিকারের জীবনতো চলমান। জীবনের অর্থই তাই। এখন যা বলবো পরে সেসব কথাই আমারই পছন্দ হবে না হয়তো। জীবনের অর্থ শুধুই জীবন, জীবনযাত্রা, অবিরাম যাত্রা। ভাবনার আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হয়ে ক্রমশ নিরপেক্ষতার দিকে যাত্রা। নিরপেক্ষ না হতে পারলে নতুন কৌশল রপ্ত করে নেবো যাতে মনে হবে আমি ঠিক কি, সহজ হবে না নিরুপন করা! খুব সহজ নয় এমন কৌশল রপ্ত করা, তবু আমরা কখন কখনো করি। হয়তো সমাজের ভালোর জন্য করি, অথবা জীবনের ভিন্ন ধরনের প্রেক্ষিত নিজের অজান্তেই রচিত হয়ে চলেছে আমার মধ্যেই। আমার অতীত অবিন্যস্ত। ভবিষ্যতের কল্পনা করি কিন্তু তাকে কিছুতেই ধরতে পারি না। কি হবে ধরে। কি হবে? পূর্ণিমা অতিশয় বিশুদ্ধ। সংসার টিকে থাকুক, দু’বেলা ভাত কাপড়ের অনিশ্চয়তার মধ্যেই দু’মুঠো সঞ্চয়ের বাসনাও আমার মধ্যে আছে তাই ভেঙে যায় সঞ্চয়ের অভিযাত্রা।

 

বহুকাল তা প্রায় তিরিশ বছরের দাম্পত্যযাত্রায় আমরা কখনো নির্ভাবনায় নিজেদের কাজটুকু স্বচ্ছন্দে করতে পারিনি। বেঁচে থাকার সর্বোত্তম পন্থা কি? একটি সরকারি চাকরি। পূর্ণিমার এমত নিবেদন আমি কান দিইনি। আমার মধ্যে তা বলে ভাবনাহীন, চিন্তাহীন এক বিচিত্র শূন্যতার জগৎ সৃষ্টি হয়েছে? তা কিন্তু নয়, তা হলে এত কবিতা লিখতে পারতাম না। তা বলে নিশ্চুপ নিথর অকর্মণ্য  থাকিনি কখনো। নিজে কাজ তৈরী করেছি। কতরকমের কাজে নিয়োজিত থেকেছি তার শেষ নেই। অভ্যন্তরের নির্মাণকে তো আর ছিঁড়ে কুটি কুটি করা যাবে না। সেসব জাবরকাটার কাজ চলতেই থাকবে। নির্মাণ আর নির্মাণ, সীমাহীন সেই সব চিন্তার ক্ষেত্র। কল্পনা আর ভাবনা, ভাবনা আর তার রুপদান। কখনো স্থির কখনো বা অস্থির। নদীর মতো। হৃদস্পন্দনের মতো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ। সেই একই দৃশ্য। সেই একই প্রেম, ভালোবাসা। সেই একই দৃষ্টি। একই সচল জীবন-প্রবাহ। বিস্তৃত বিবরণের কি প্রয়োজন! দাবদাহ আছে, বৃষ্টি আছে, রঙ আছে, ধূসর পাণ্ডুলিপিও আছে। আছে, থাকুক, আমার যা খুশি লিখে যাই। তোমরা ক্রমশ আমার মধ্যে ডুবে যাও। সীমাহীন। অকারণ আক্ষেপের কি প্রয়োজন। সফলতার উল্টোদিকে মৃদু হলেও স্বার্থপরতা কি লুকিয়ে থাকে না। কৃতি মানুষ কাকে বলবো! সফল স্বার্থপর মানুষ কে? অনেক চিন্তার স্রোত আপাত নিরুদ্দেশের পথে। বাস্তবতার টুকরো টুকরো ভাবনারা ব্যর্থ হতে পারে না। কত ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে তবেই তো যথার্থ মানুষ। নিজের উপর বিশ্বাস আছে, যাকে অপর মানুষেরা ব্যর্থতা বলে তার ভার আমি নিজের উপর চাপাতে চাই না। ইতিহাস সম্পৃক্ত বীজ থেকে আমার জন্ম, অভ্যন্তরে চিহ্নিত আছে নানা উল্লম্ফন, জন্মের বিকাশের পরস্পর অসংলগ্নতার মধ্যে মৃত্যু পর্যন্ত। আমি কিভাবে বেঁচে আছি সেটা বড়ো কথা নয় আমার কাজের পরিধি ধারাবাহিকতা আসলে উজ্জীবনের শক্তি না থাকলে এমন ভাবে বেঁচে থাকা যেতো না। অর্থহীন, জঞ্জাল বলে কিছু নেই। প্রকৃতিতে অর্থহীন বস্তু বলে কি কিছু আছ! সবই আপাত। তাত্ত্বিকের দুনিয়ায় বলা উচিৎ ব্যর্থতার ভার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা একটা থাকে। সে কিছু নয়, আসলে বাস্তবতাই সার কথা। আর বাস্তবতাকে সবসময় মেনে নিই। অকারণ আক্ষেপ করি না।

 

রূপান্তরের একটা হিসেব আছে, আমার মনে হয় সঠিক রূপান্তরে কোনোদিন শ্যাওলা ধরে না, মরচেও পরে না। প্রবাহগুলো ভাসতে ভাসতে মহাসমুদ্রে মেশে, হিমালয়ের উচ্চতায় উঠে যায়, একটার পর একটা মরুভূমি অতিক্রম করে তবেই না মহাসমুদ্র, টাইগারহিল, কাঞ্চনজঙ্ঘা। টুকরো টুকরো কাজ, নিজের অজান্তেই একই সূত্রে মালাগাঁথা হয়ে যাচ্ছে দেখে নতুন উল্লম্ফনে চিৎকার করে ওঠে।

‘দেখিলাম একালের আত্মঘাতী মূঢ় উন্মত্ততা’

দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ, বিশেষ দেশ ও কালের, মূল্যায়নের জীবন্ত প্রতিরূপে মনোযোগ দিতে সেভাবে কেন পারলাম না, কে জানে! তবু ভাব ও ভাবনারা কবিতায় সংগোপনে ঢুকেছে আমি বুঝতে পারিনি। এই না বুঝতে পারাটা সঙ্গত। কেননা আমার লেখার উপজীব্য তো আর শুধুই কল্পনাশ্রিত নির্মাণ নয়, যা দেখি, প্রতিক্রিয়া হয়, দার্শনিকের ভাষায় না হলেও চরণে চরণে মানবীয় আদান প্রদানের উপায় জ্ঞাপন করেছি। এক্ষেত্রে অতীতের স্মৃতি সদা জাগ্রত থেকেছে, তাই বলতে পারি পৃথিবীর এই প্রান্তের ভবিষ্যৎ বরাবরের জন্য অনির্দিষ্ট ছিল। এখন পঞ্চায়েত ব্যাবস্থার সুফল ব্যঙময় একথা অস্বীকার করতে পারি না। পঞ্চাশ বছর আগেও দুর্ভিক্ষের পরিবেশ দেখেছি, এখনও এখানকার অসংখ্য কালাহান্ডির ছবি ফুটে ওঠে খবরের পাতায় টি.ভি’র পর্দায়। খিদের বোধ নষ্ট হয়ে যাওয়া হাড্ডিসার, পিত্তজ্বালা, দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মানুষেরা এখানেও আছে, ডুয়ার্সে চা-বাগানগুলোর ছন্নছাড়া দশা দেখলে মর্মাহত হবার রুক্ষ কঠোর অনুভূতিগুলো জেগে ওঠে। কালচিনির না খেতে পাওয়া মানুষগুলো এখনো ম্যালেরিয়া, ব্ল্যাক-ওয়াটার ফিভার, রক্তাল্পতা, ক্রিমিকীট, রাতকানা, যক্ষ্মা আরও কত শারীরিক মানসিক দুর্বলতার শিকার তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। চিকিৎসা পরিষেবার চিত্রটি অত্যন্ত করুণ, অসংখ্য চা-বাগানে হসপিটাল আছে। তাদের পরিষেবা নামমাত্র। ভালো ডাক্তার নেই, লাইসেন্সসিয়েট মেডিক্যাল প্র্যাক্টিশনার যুগ যুগ ধরে চিকিৎসা করে চলেছেন। ডিসপেনসারিতে নিম্নমানের ওষুধ, এখনো এই দুর্ব্যবহার চলছেই। চা-বাগানে ইউরোপিয়ান কালচার ছিল। সাহেব সুয়েবদের যেমন অত্যাচার ছিল তেমনি উল্টোদিকে কিছু পরিমাণ মানবতাও ছিল। সেই অনুশাসনের মূল্যবান সংস্কৃতি এখন আর নেই। শুধুই চুষে চুষে ছিবড়ে করে দেওয়া হচ্ছে মানুষ অ প্রকৃতিকে। মালিকানার হস্তান্তর চলছে খুব শর্ট-ইন্টারভেলে, যা স্বাধীনতার আগে ছিল না। পরিচর্যার কৃপণতায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে চা-বাগান। উন্নত মানের চা তৈরীর ইচ্ছের চেয়ে এখন সমুদয় প্রবৃত্তি লেগে রয়েছে পরিমানের দিকে। কতবেশি চা-উৎপাদন করা যায় এটাই লক্ষ্য। কত অল্প সময়ের মধ্যে সুদে আসলে আত্মসাৎ করা যায় সে চেষ্টায় এখনকার মালিকবর্গ। হায়, রেইন-ট্রি, শেড-ট্রি পর্যন্ত কেটে চালান করা হচ্ছে, মাফিয়া ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে এদের। কোথায় চা-বাগানের চেহারা পাল্টে যাবে সবুজ সুন্দর স্বাস্থসম্মত বাগান ফুলে ফলে পাতায় পাতায় উজ্জীবীত থাকবে তা নয়, শুধু শুষে নেওয়া। বাগানের প্রতি ভালোবাসার আবেগে স্বতস্ফুর্ত থাকার দিন শেষ। কথায় কথায় বন্ধ লকআউট আর কত কি! যে লোকগুলো ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা থেকে অনেক উজ্জ্বল আশা নিয়ে এসেছিল তাদের ছয় পুরুষের পরেও যে সেই হারিয়া, কান্ট্রেলিকার, জুয়া, অশিক্ষা আর উদ্দেশ্য বিমুখতা তাদের ছেয়ে আছে। পাতা তুলতে তুলতে জীবন শেষ হয়ে গেলো। মাথার উপর অ্যান্টেনা আর চটশ্রীতে (অস্থায়ী সিনেমা দেখবার প্রজেক্টার ইত্যাদি) রগরগে সিনেমা দেখা ছাড়া এদের জন্য আর কোনো এন্টার্টেনমেন্ট নেই। মদ আর জুয়া খেলার মধ্যে কেটে যায় জীবনের বেশিটা সময়। হায় ভারতবর্ষ, তোমার স্বপ্নের ডুয়ার্স-ভ্যালির এই করুণ কাহিনী তোমার অঙ্গে আর কতকাল ঠাণ্ডা বাতাস দেবে বলো!

 

দল ভেঙে ছুটে চললো দাঁতাল,

কোন দিকে যাবে?

 

মদ নেই কোথাও মারুয়া নেই

ধান ক্ষেতে আগুন লেগেছে।

শস্যকণা কুয়াশায় তির্যক

গুছিয়ে স্বপ্নের কথা বলা হয় না

                   ভোগে যে মন নেচেছিল আগে

এখন যেদিকে খুশি যা বলে

ইশারায় চাষিকে নির্দেশ পাঠায় প্রকৃতি

 

চাষির খামার ভেঙে গেছে

ট্রাক্টর তছনছ

সামান্য ভুট্টার ক্ষেত জুড়ে

হাতিদের নতুন পিকনিক…

 

সামাজিক চেতনা ও অন্তর্গত বোধের অবিমিশ্র জীবন। এই আমার ডুয়ার্স-ভ্যালির দিন রাত্রি। নিথর কোনো ওঠা পড়া নেই জীবনের। ঘোড়া দৌড় কিংবা কারখান বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সুযোগও নেই যাতে মানুষের মধ্যে আলোড়ন হতে পারে। প্রশ্নই ওঠে না। চা-বাগানগুলোর বন্ধ হওয়া থেকে যে আলোড়ন হয় তা একটি প্রত্যন্ত বনাঞ্চলের মধ্যেকার আলোড়ন, এক সঙ্গে সবকটি চ-বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমনটা হয় না, কেননা এক একটি চা-বাগানের মালিক এক একজন। একটি চা-বাগানের উৎপাদনে কোয়ালিটি এবং পরিমানেও যথেষ্ট তো সে বাগানের চেহারা আলাদা হবেই। সবই নির্ভর করে মালিকের চিত্তবৃত্তির উপর। আলোড়নের আর যে সব সূত্র আসে সেগুলো খুব বেশি কার্যকর নয়। এখানে চাষের জন্য যে সেচ ব্যবস্থা আছে তাকে স্লোগান দিয়ে সরকারিভাবে বলা হয়েছিল তিস্তা প্রজেক্ট ‘দ্য ব্রেড অফ নর্থবেঙ্গল’। বলাতেই শেষ , দীর্ঘ মেয়াদি প্রজেক্টের কতটা সার্থক হয়েছে তা বলা কষ্টকর। তিস্তা-প্রজেক্ট কত সাম্যক গতিতে এগুচ্ছে তা একমাত্র চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।। খাল কেটে কেটে কৃষি জমিতে তিস্তার জল সেচের কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনাটি সুন্দর, কিন্তু তিন চার যুগ পেড়িয়েও ডুয়ার্সের কৃষক কিন্তু জলের হদিস পান নি। ডোবা আর ছোট ছোট নদী থেকে নিজেদের চেষ্টায় পাম্প করে জল চাষের কাজে ব্যবহারে খরচ অনেক বেশি, আর জল না হলে চাষই হচ্ছে না। এমত অবস্থায়ও এখানে আলোড়ন হয় না। আন্দোলনের টুটি চেপে ধরেছে পাইয়ে দেওয়া আর ভুর্তুকির রাজনীতি। সরকারী বদান্যতায় মানুষ না খেয়ে মরছে না বটে, তা বলে স্বাবলম্বীও হচ্ছে না তারা। একশ দিনের কাজের বিকল্প খুঁজে বের করা দরকার। নতুন ভাবনা দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করা খুবই জরুরি। কৃষিকাজে বর্তমানে যারা নিয়জিত আছেন বলে আমরা দেখছি আসলে তারা কিন্তু জমি হারা মানুষ অথবা জমিটাই বন্দক দিয়ে কৃষি শ্রমিকে পর্যবসিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে ভালো মন্দ দুটো ছবি ফুটে ওঠে। ভালো হচ্ছে ৩০ভাগ আর ৭০ভাগই হচ্ছে অসম্মান আর অসম্মানের জীবন। আমর জমিতে যদি আমিই চাষ করি এবং যে ব্যবস্থাটা মেনে নিয়ে চাষ করেছি সেটা আর কিছু নয় কৃষি শ্রমিকের দশা। আমি সম্মানিত কৃষকের ভূমিকায় আর থাকতে পারলাম না। এটা একটা নির্ভরতার দিক। জমি বন্ধক দেবার জন্য পয়সা পাচ্ছি এবং পরিশ্রমের মূল্যও পাচ্ছি। ব্যক্তি উপার্জনের নিশ্চয়তা কিছু পরিমাণে থাকছে। অপরদিকে ছোট কৃষক নিজের এক টুকরো জমি চাষ করে সে রকম ফয়দা তুলতে পারছে না। জমিতে আর লাঙল দেওয়া যাচ্ছে না, বলদ রাখার জন্য যে নিত্যদিনের খরচ তা হিসেব করলে অন্যান্য উপায় থেকে অনেকটাই বেশি, সুতরাং ট্র্যাক্টর ভাড়া করে আনতে হবে নিদেন পক্ষে পাওয়ারটিলার ব্যবস্থা করতে হবে, সেখানে খরচা। বীজ এবং শুধু বীজ হলেই হবে না অবশ্যই শোধন করা বীজ চাই নইলে ফসলই আসবে না। সার সেচ এবং পেস্টিসাইডের সঙ্গে শ্রম। এত কিছু করার পরে দেখা গেলো মাটির নিচের আলুতে ধসা লেগেছে। সর্বনাশের চূড়ান্ত। বিঘের পর বিঘে গমের শিসে অপুষ্টি, ধানের সিসে দুধ আসে নি, ফাঁকা। এর ওপর হাইব্রিড ইত্যাদির ঝুঁকি তো আছেই। কর্পোরেট দুনিয়ার হাতে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে কৃষি জমি। এটাও এক ধরনের বিপরীতমুখী বিপ্লব।

বাজারে তরিতরকারির আমদানি দেখলে অবাক হতে হয়। এক সময় ধান পাট আর তামাকের আরত ছাড়া আর কিছুই ডুয়ার্সের হাটে বাজারে চোখে পরতো না সেখানে ধূপগুড়ি, ফালাকাটা, ময়নাগুড়ি, দিনহাটা আর হলদিবাড়ির মতো জায়গাগুলোতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে শস্যভাণ্ডারে। চাষের গতিমুখ সত্যিই অনন্য। পঁচিশ বছর আগেও ভাবা যায়নি এমনটা হবে! প্রকৃতি সহায়, চাষের প্রতি বিত্তবানের আগ্রহ, উপযুক্ত পরিকল্পনা সব ঠিক আছে কিন্তু কৃষকের অবস্থায় পরিবর্তন হয় নি। কৃষক যে তিমিরে ছিল আছেও সেই একই তিমিরে। ঢাক ঢোল পিটিয়ে উৎপাদনের অগ্রগতির পরিসংখ্যান ছাপা হচ্ছে বটে, কিন্তু সে সব সুখের হাসি খেলছে কাদের চোখে! কৃষকবংশের সবাই সেই কৃষকই থেকে যাবেন এমনটা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, তা হলে জমি যার লাঙল তার স্লোগানের তাৎপর্যও নেই, ফুরিয়ে গেছে পুরনো ধ্যান-ধারনা সমূহ। আর কিসের বিপ্লব? কৃষক নিজেই তার জমি দিয়ে দিচ্ছেন উচ্চবিত্তের হাতে, মানুষ ঝুঁকে পড়েছেন ট্রেডিং এর দিকে, কেনা বেচা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তারা, উৎপাদনের ছোট ছোট ইউনিটি হতে পারতো প্রতি বর্গকিলোমিটারের পরিসরে, ঘরে ঘরে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠতে পারতো, সে সব কিছু নয় উৎপাদিত ফসলের বাজারজাত করবার সুবন্দোবস্তই করা গেল না তো কৃষিজাত সামগ্রী ভিত্তিক প্রসেসিং-প্যাকেজিং সে তো অনেক দূরের কথা। সব কিছু ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আমলা আর সরকারি কর্মচারিদের উপর। মানুষের নজরটিকে ছোট করে রাখবার প্রবণতা। আর কিছু নয়, ‘সেলফ্ হেল্প গ্রুপ’ করে একটা চেষ্টা চলছে, সে সব কিছু প্রায় নিঃস্ব মানুষদের স্বনির্ভর করাবার পরিকল্পনা, ভালো, কিন্তু, সেখানেও ট্রেডিং, জিনিস কেনো আর বিক্রি করো, সেই ফইরা, মিডল্-ম্যান। মানুষকে কত বেশি ঠকাতে পারো ঠকাও। এভাবে হবে বলে যারা বিশ্বাস করেন তারা আসলে নির্বধের রাজ্যে বাস করছেন। কৃষিতে উন্নতি হয়েছে, কিন্তু লাভের অংশটাই চলে যাচ্ছে বিনিয়োগকারীর হাতে। নতুন কর্পোরেট দুনিয়ায়। সম্পূর্ণ বাজারটিকে ধরে রাখবেন তারাই। ছোটো ছোটো চাষির কোনো ধর্মই  থাকবে না। রিটেইল হোলসেল ঘুরে ফিরে তাদের দখলে। জমির সব ফসল তারাই কিনে নেবেন এবং ইচ্ছেমত দামে তারাই তা খুচরো বিক্রি করবেন। সরকার ঠুঁটো জগন্নাথ। জীবন যৌবন সবই তাদের পায়ে সঁপে দিতে হবে। হায়! বড় মাছ ছোট ছোট মাছগুলোকে গিলে খাবার মতো। এটাই হয়তো ইকোলজিকাল ব্যালেন্স। প্রকৃতির নিয়ম। ডুয়ার্স, বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ তো নয় যে এ সবের স্পর্শ বা আঁচ তার গায়ে লাগবে না।



                                                          [প্রকাশিত 'কবিতার লাইটহাউস' চার বছর, পূজো সংখ্যা]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

Kartik বলেছেন…
Onake khub kachh theke dekhechhi. Onar kobita porechhi. Valo lage amar