গুচ্ছ কবিতা
সন্তোষ সিংহ
শূন্য পুরাণ
১
শোনো তবে আজ আমার বৃত্তের বৃত্তান্ত কিছু বলি বলি সেই গোল যার চারদিক জুড়ে
প্রাচীন ঝুরির মতো পথ ঝুঁকে আছে অগণিত পথ অসম বিষম সুসম পথ কঠিন তরল সব
বায়বীয় পথ ঝুঁকে আছে আমি ক্রমাগত ঝুঁকে পড়ছি সেইদিকে আমাকে ধরার কেউ নেই
মাধ্যাকর্ষণের সমস্ত শিরা-উপশিরা জুড়ে ঠান্ডা শুধু ঠান্ডা আমি নিজেকে সামলাতে পারছি
না সামলাতে সামলাতে পড়ে যাচ্ছি যদি পড়ে গিয়ে নদী হতাম অধরা শিল্পের ময়ূরপঙ্খী
নাওগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতাম সঙ্গম অবধি যদি ডাকসাইটে পরি হতাম মুকুট-পরা
রাজকুমারদের ছুটিয়ে নিয়ে যেতাম সসাগরা সিংহাসন অবধি যদি জাদুকরি মেঘ হতাম
সাহসী বজ্রকে বেঁধে ফেলতাম মনের মণিকোঠায় তাহলে কি বেঁচে যেতাম হে জিন দেবতা
তা হলে কি নিরাত্মা হতাম?
২
আমার তো আলোক ছাড়া আর কোনো ভাষা জানা নেই
তুমি বলো, বৃত্তের ওপার কে ছুঁয়ে আছে
উঁচু শৃঙ্গের ওপরে কে হা হা করে ওঠে
কে দুঃখী মানুষের মনের বেলুনে রাত্রি ছড়ায়
কে?
আমি পারছি না সামলাতে
হে ঈশ্বর, ভার নিয়ে পড়ে যাচ্ছি
আজ আমাকে মানতেই হবে সমস্ত ঢালুকে
মানতেই হবে পতনের শেষে সেই ‘হা হা’
সেই সত্য-শূন্যতা, লোকমান্য মহাবিভ্রম
মৃত্যু কি বিকল্প শূন্যতার?
মৃত্যু তো অনেক ভালো তুমি জানো
মৃত্যুর একটা শুরু আছে আর শেষ
কিন্তু শূন্যতার?
৩
আমার তো আলোক ছাড়া আর কোনো ভাষা জানা নেই
শূন্যতা তোমাকে ধন্যবাদ
তুমিই তো আলোকের পথ
শূন্যতা তোমাকে ধন্যবাদ
তুমি আছ তাই উড়তে পারছি
ধুলোকণা তাই লীলাময় হয়
তুমি আছ তাই নকশার থেকে রাত্রির থেকে
কবিতার যত অক্ষর থেকে উঠে এসে
ছুটে যাই ওই বায়ুপথ বেয়ে লক্ লক্ করে
ছুটে যাই আর
প্রথম জন্মদিন আবিষ্কার করি
প্রথম ছবি আঁকার দিনটি আবিষ্কার করি
প্রথম কবিতা লেখার দিনটি আবিষ্কার করি
প্রথম ফুলশয্যার দিনটি আবিষ্কার করি
প্রথম মৃত্যুর দিনটি আবিষ্কার করি
আর মেলে দিই ডানা
আর ভাবি
কবে নেলপালিশ ঢাকা নখ ছিল সার্থক জনম
কবে জয় সাবানের গন্ধ ছিল সার্থক জনম
কবে লজিং-বাড়ির কালো মেয়েটির চিঠি পাওয়া ছিল সার্থক জনম
কবে ভবানী সিনেমার ম্যাটিনি শো ছিল সার্থক জনম
কবে পার্কের অন্ধকার বেঞ্চ, হঠাৎ ধর্মঘট ছিল সার্থক জনম
কবে হালুম বৃষ্টির এক ছাতার নীচে ছিল সার্থক জনম
ভাবি আর
আরও কত ‘সার্থক জনম’ দিয়ে
শূন্যতাকে ভরাট করি
শূন্যতাকে খুশি করি
শূন্যতাকে উপহার দিই :
আরামের সুদৃশ্য ডিভান ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স এলআইসি
পিয়ারলেস শেয়ার মার্কেট ইন্দিরা বিকাশ ফ্রিজ
টিভি গ্যাস ফোন প্রোমোশন ফ্ল্যাটবাড়ি নীল গাড়ি
দামি নারী ভি সি আর
‘ইত্যাদি’র মধ্য থেকে তুলে এনে
আরও কত স্বস্তি উপহার দিই
তবু শূন্যতা কি খুশি হয়?
তাই উলটোপালটা পাঁচজন বন্ধুর আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা কিনে নিয়ে
শূন্যতাকে উপহার দিই
অতি সত্যের কাছে ভয়ংকর বেঁচে থাকা দশমাস দশদিন
শূন্যতাকে উপহার দিই
তবু কি শূন্যতা খুশি হয়?
তাই মেলে দিই ডানা
আর অশেষ শূন্যের ঢালু পথ বেয়ে নেমে যাই
প্রথম আকাশ ভেদ করে যাই
দ্বিতীয় আকাশ ভেদ করে যাই তৃতীয় আকাশে
আলোহীন কালোহীন নিরাত্মার দেশে
আর চেয়ে দেখি:
লিঙ্গবিহীন মানুষের রূপ
প্রকৃতিবিহীন মানুষের রূপ
বচনবিহীন মানুষের রূপ
বিভক্তিহীন মানুষের রূপ
প্রত্যয়হীন মানুষের রূপ
ধাতুহীন সব মানুষের রূপ
নিরোপসর্গ মানুষের রূপ
দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে
ব্যাকরণহীন উড়তে থাকি
উড়তে থাকি উড়তে থাকি…
দুয়ারে অপেক্ষমান মেয়ে
‘তুমি রোজ রাত করে ফেরো কেন, বাবা, কোথায় গিয়েছ?’
এই একরত্তি সামাজিক মেয়েকে আমি কী করে যে বলি,
আমি কোথায় গিয়েছি, আমার কোথায় যাওয়া উচিত
আমি বলি-বন্ধুদের কাছে। ‘ মাও তো বন্ধু তোমার, তুমি বলেছিলে ’।
এরকম পালটা প্রশ্নে আমি করাতের দাঁতে দিয়ে পড়ি
আমাকে করাতী এক ফালা ফালা করে একসূত তক্তা বানিয়ে
চতুর ছুতারের কাছে যেন বিনামূল্যে বিক্রি করে দেয়-
আমি র্যাঁদার ওপার থেকে ওকে কিভাবে বোঝাই
মানুষের কাছে আমি যাই না বহুদিন, তার সহবাসে
মানুষের ছায়া সাপের পেটের মতো নিম্নগামী রসাতল
শূন্যতার নাভিকেন্দ্র শুধু, আমি জানি, খুব ভালোভাবে জানি-
মানুষের চেয়ে ওই তরল অনেক বিশ্বাসী
নীল ও কালো মানুষদের অনাথ আশ্রম-
এই একরত্তি সামাজিক মেয়েকে আমি কী করে বোঝাই
আমার বন্ধুরা সব নদী, আমি বলি- আমি যাই জলে
জলের নদীতে, জলপরিদের কাছে, তাদের প্রিয় নাচ দেখি
পিছুটানহীন, দুয়ারে অপেক্ষমান মেয়ে
জল শূন্য মরা নদী, মার দিকে তাকিয়ে রয়েছে…
দাগ
একটু একটু করে তুমি সরে যাচ্ছ
আর বর্ষা নামছে একটু একটু করে
অ্যান্টেনায় জমে উঠছে বিষণ্ণ ঘুড়ির মতো মেঘ
ভাঙা ভাঙা
তোমার পায়ের দাগ ঢেকে রাখছে বিষাদের জল
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি
একটু একটু করে তুমি কী গভীর স্বচ্ছ হয়ে উঠছ
নেগেটিভ ফটো-প্লেট থেকে
আর থান-পরা রাঙাদির কথা মনে পড়ছে
বেশি বেশি
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ফ্রেমের বাইরে
ভেসে যাচ্ছে তোমার চুল চোখ গলা
আর তোমার পায়ের দাগকে ঘিরে বিষাদের জল
কত স্মৃতির জটলা।
ও সুটুঙ্গার কাঠের পুল
সেই কবে থেকে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার, মনে পড়ে?
যতদূর মনে পড়ে নিত্যদা-ই
তোমার কাছে এনেছিল আমাকে প্রথম
নিত্যদা, যাকে আমি বন্ধু বলি
যাকে পাখি বললে যে বলে আকাশ
যাকে বীজ বললে যে বলে মৃত্তিকা
যাকে আগুন বললে যে বলে প্রতিভা
যাকে রেখা বললে যে বলে ক্যানভাস
সেই নিত্যদা-ই আমাদের জোড় বেঁধেছিল, মনে পড়ে?
সেই যেবার নানারকম আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল
আমার ঘরবাড়ি স্বপ্ন সম্ভাবনা
যাতে সেই আগুনের হলকার কালো ধোঁয়া
আমাকে কালি করে না দেয়
যাতে আমার হার্টের অসুখ না হয়
যাতে আমি সুবাতাস নিয়ে আরও কিছুদিন
ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারি-তাই
সেই যে-বার আমরা দু-ভাই
ঝগড়া করতে করতে আলাদা হয়ে গেলাম
আর আমাদের মা লজ্জায়
দুই ভূ-খণ্ডের অতল অন্ধকারে হারিয়ে গেল
সেইবারই তোমার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ
তারপর কত চুমকি-বসান নিশুতি রাত কত ঘুঘু-ডাকা-সন্ধ্যা
কত মেঘভার দুপুর কত বিসর্জনের জিরো আয়ারে
নিত্য যাওয়া আসা কত হলুদ বাদামি নীল অবকাশ
আমাকে বলেছ আমিও বলেছি কত সন্ধ্যা রাত্রি না-ফোটা-সকাল
বলে বলে হালকা হয়েছি আমার বিষণ্ণতার কত নোনা জল
তোমার বুকের জলে মিশে আছে
তুমি জানো
তবু
ও সুটুঙ্গার কাঠের পুল,
একেক সময় মনে হয়
একদিন এ জীবন যেভাবে করেছি শুরু
তার সবটাই জন্মমৃত্যুহীন
শুধু-স্মৃতি ভস্মে দু-একটি ঘটনার ধক ধক রুপালি শেকড়
মাথার খুলির ভিতরে পোড়াদাগ
যেন এক জন্মের কুয়াশা ধরে আছে
ক্কচিৎ কখনো জলঝরনার ধ্বনি
বাঘ হরিণীর রঙ্গ মনে পড়ে
ও সুটুঙ্গার কাঠের পুল,
যতটুকু মনে পড়ে তোমাকেই বলেছি আমি
কে আমায় খাইয়েছিল জোর করে ডাসা পেয়ারা নাবালক সন্ধ্যায়
কে আমায় বানিয়েছিল আনকোরা নৌকার মাঝি
খড়ের গাদায়
কে আমায় বানিয়েছিল মই জীবনের কূট পরীক্ষায়
তোমাকে বলেছি সব
ও সুটুঙ্গার কাঠের পুল, তুমি সাক্ষী থেক
তোমার পায়ের নীচে চন্দ্রখচিত পুণ্যজল
মাথার উপরে আবহমান নক্ষত্রমণ্ডল
তুমি সাক্ষী থেক
বিগত সকালগুলোর, প্রবাহিত রৌদ্রগুলোর
অপেক্ষমান রাত্রিগুলোর
তুমি সাক্ষী থেকো
কে আমায় বলেছিল ছাদনাতলা স্বর্গের সিঁড়ি
সহবাস স্বর্গের দ্বার মৈথুন দরজার টোকা
তারপর দরজা খুলতে পারলে স্বর্গ কবিতার
কিন্তু তারপর
কে আমার বিশ্বকে
ভেঙে
ভেঙে
ক্রমে
ক্রমে
উপহার দিয়েছিল বর্ণাশ্রম এই ঘর সংসার
ও সুটুঙ্গার কাঠের পুল,
কত ঋতু, অশ্রু, নির্জন ভেঙে তোমাকে বলেছি
কার জন্য আজ আমি স্বর্গভ্রষ্ট হতমান গার্হস্থ্যজীব
ও সুটুঙ্গার কাঠের পুল
আমি জানি শ্রমের বিকল্প কিছু নেই
আমি জানি আলুপটল মাছ ঝোল
আকাশের চাঁদ মাসিকের সপ্তম রাত
কমপ্ল্যান বয় কমপ্ল্যান গার্ল
কোকাকোলা মারাদোনা
সুযোগের এক হাত কংক্রিটের ছাদ
বাংলার গ্রাম থি-এক্স রাম
বর্ষার খিচুড়ি গরমের চাটনি
টাইগার হিল গ্র্যান্ড হোটেলের বিল
আমি জানি কোনো স্বর্গ নয়
কবিতাই স্বর্গ আমার
তুমি জানো সেই স্বর্গ যে দেখাতে পারত দেখাল না আর
কিন্তু সে-ই খুলতে পারত দরোজা
যেভাবে একদিন শিবরাত্রির মেলায় এক বেলুনওয়ালার
বেলুন মোচড়ানোর শব্দ আমাকে দরোজা খুলে দিয়েছিল
যেভাবে একদিন এক জলঢোঁড়া সাপের এক সোনা ব্যাঙকে
নাভি কেন্দ্রে নেয়া আমাকে দরোজা খুলে দিয়েছিল
যেভাবে একদিন এক বোরখা-খোলা বিপন্ন-গোলাপের
মার্কিন মুলুকে বেপরোয়া ফুটতে-চাওয়া
আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল
যেভাবে একদিন এক ব্লু ক্যাসেটের আশ্রম থেকে খাকি-হাওয়ায়
বেরিয়ে আসা আমাকে দরোজা খুলে দিয়েছিল
সেইভাবে-
নাকি কোনোদিন দরোজাই খোলেনি? আজ মনেও পড়ে না
শুধু স্মৃতি ভস্মে দু-একটি অলৌকিক নূপুর
বিদ্যুতের মতো ছুটে এসে কুয়াশার ভিতরে
বাজতে থাকে ঝুম ঝুম ঝুম
ও সুটুঙ্গার কাঠের পুল,
তুমিই তো বন্ধু আমার
যখন দেখি কালো পাথরের গায়ে রাত্রি বিছিয়ে
তুমি আকাশ কুড়োও, জ্যোৎস্না কুড়োও রূপকথা হয়ে
সুটুঙ্গার চুলে বিলি কাটো
ভাওয়াইয়া গানের সুরে অবকাশ মদির করে তোল
তখন মনে হয় আমারই ইচ্ছাগুলো যেন খুঁজে পায়
স্বপণ সারাৎসার
যখন দেখি ডাকাত হাওয়ারা এসে
হ্রেষা-শব্দে তোমার যৌবন কাঁপায়
ধূর্ত বন্যার জল আব্রু সরিয়ে
তোমার হাজাধরা দু-পা টেনে ধরে
ইজ্জৎ লুটবে বলে কচুরিপানার দাম তোমাকে ঘেরাও করে
তখনও তুমি প্রাণপণ ধরে থাকো দু-কূল তোমার
তখন তোমার ভিতরে আমিই আমাকেই দেখতে পাই
যেন আমারই ইচ্ছাগুলো সেতু হয়ে শুয়ে আছে এপার ওপার
সেতু হয়ে প্রাণপণ ধরে আছে আকাশ ও মাটি
সেতু হয়ে ঝড়ে জলে ধরে আছে কবিতা ও সংসার!
বাজার
চার পেগ দিন খেয়ে সূর্য এখন ঢুলুঢুলু, বেহুঁশ
মা বলল, বাজারে যাচ্ছি কী আনব বল
ঝুপড়ির ভিতর থেকে মেয়ে হল উজ্জ্বল
বলল, পান সুপুরি দোক্তা আর একটা মানুষ
আয়না
আমার ড্রেসিং টেবিলে দীর্ঘ আয়নার উপর কোনো ছাদ নেই
আমার আয়নায় আকাশ চুঁয়ে পড়ে গাঢ় নীল চুল
ভাঙা ডিমের খোলের মতো দোমড়ানো চাঁদ ঝুলে থাকে
অদ্বিতীয় মুখ খাদের গভীরে
আয়নার সামনে থিতু হয়ে বসে আছে পাউডার
স্নো কাজল চিরুনি গন্ধ তেলেরা
তারা মাঝেমধ্যে দেখে নিচ্ছে বিদ্বান আলোয়
বিম্বিত মুখে ঘাড়ে আরও কোনো থাবা পড়ে কিনা
1 মন্তব্যসমূহ