রথীন্দ্রনাথ সাহা'র কবিতা


 

বাড়ি ফেরার সময়

প্রথম প্রকাশ মার্চ, ২০১৭

প্রচ্ছদ ব্রতীন সরকার

প্রকাশক কবিতার লাইটহাউস।

মূল্য ৪০ টাকা

 

রথীন্দ্রনাথ সাহা, জন্ম ১৯৮৮, বালুরঘাট শহরে। পেশায় কাঠমিস্ত্রি। ২০০৪ থেকে লেখার শুরু, পত্রপত্রিকায় প্রকাশ সময় মূলত ২০১০-এর দিকে। বর্তমানে শিলিগুড়ির বাসিন্দা, রথিনের অন্ধকার তাঁর লেখায় গাঢ় হয়ে দেখা দেয়।

 

বাড়ি ফেরার সময়


১।
ঘরে ফেরার ভান করে
নদীকে নিবেদন করি জন্মকথা
সন্ধ্যার পাখি-ভেজা শহর
ক্ষতের পাশে নেমে আসা আচমকা মেঘ
পুনশ্চ বেজে ওঠে রাত
যে যার সন্দেহ ভাঁজ করে রাখে
যুদ্ধ শেষে কেউ কেউ বনে চলে যায়
কেউ বৃত্তান্ত লিখি
 

২।
কাঠের কারবার করতে করতে কাঠ হয়ে গেছি
ভেতরে কান পাতলে কাঠপোকা বাজে
ঝাঁকালেই গুঁড়ো ঝরবে, শূন্যতার...
অথচ কাঠের আগুনে পুড়বে বলে আজন্ম জেগে থাকে
মরে যেতে চায় কেউ কেউ
আর পাতাকুড়ুনিরা জানে
একদিন সমস্ত কাঠ ফুরিয়ে যাবে
কাঠের স্মৃতি নিয়ে লেখা হবে ধামসা বই
অদৃশ্য মলাটের
মানুষও তো একটা বই
যার মধ্যে সুখ দুঃখের গান লেখা থাকে
 

৩।
মানুষের কথা লিখতে গিয়ে
অন্ধকার লিখে ফেলেছি
এমন এক দুঃখের কথা লিখে ফেলেছি
যাকে স্মরণ করে বিস্তৃত মাঠ চষে ফেলছেন গ্রাম্য কৃষক
তার চামড়া-পোড়া গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়
পৃথবীর সদ্যোজাতরা কান্না করছে
আর তোয়ালা জড়িয়ে তাদের শরীর থেকে
অন্ধকার মুছে ফেলার চেষ্টা করছে কেউ একজন
 

৪।
জন্মের সময় শিশু কাঁদে
ঘুমের মধ্যে হাসে, ভয় পায়
কথা বলে আশ্চর্য ভাষায়
কেউ বুঝি না
আশ্চর্যের সারাটা জুড়ে পূর্ব জন্মের স্মৃতি
 
বয়সের সাথে ভুলে যাই
 

৫।
ভুল ভেঙে যায়
শিডিউল করে একটা গাছের নীচে গেলে
হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে ঝরে পড়ে পাতা
আর আমার মনে হয় কোনও অলীক
হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে...
খিদে পায় না, তেষ্টা পায় না
হাসি পায়, হাসতে হাসতে আয়ু-শূন্য হই
যারা স্নেহ করে, আরোগ্য কামনা করে আমার
কোল-পাঁজা করে একটা কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দেয়
সকাল থেকে রাত ভাবি এই বুঝি মরে যাব আমি
 

৬।
আমি ভূমিষ্ট হওয়ার আগে
জন্ম নিয়েছে আমার মৃত্যু
আমরা দুজনেই পাশাপাশি
ঝুলে ছিলাম যোনি থেকে
নাড়ি কাটার পর সে অদৃশ্য হয়ে গেছে
 

৭।
বাড়ির পাশে মন্দির
প্রতিদিন সকালে মা সেখানে প্রদীপ দেয়
মঙ্গল কামনা করে আমাদের
আমি মন্দিরের পেছনে সিগারেট ধরাই
ভেতরে ঢুকি না
মা বলে মন্দিরে ভগবান থাকে
আমি ভগবান দেখিনি কোনওদিন
 

৮।
আমাকে ঘুমিয়ে রেখে মা
সাপ হয়ে যায়
পাশের ঘরে
বাবা-মা ফোঁস ফোঁস করে
 
আজকাল বিছানায়
বোনের খোলস পরে থাকে
 
আমাকে ঘুমিয়ে রেখে
দেখি
ঘরে ঘরে সাপ শুয়ে আছে
 

৯।
রাত্রি গড়িয়ে যাচ্ছে সারা বাড়ি
সবাই ঘুমিয়ে পরলে টের পাই
আমার নখ বড় হচ্ছে, চুল উঠে যাচ্ছে
দাড়িগোঁফ, কপালে বিষব্রণ
জুম করি নিজেকে
ভেতরে পুঁজ, রক্ত, অভাব, অন্ধকার...
 
আমি আমার একেকটা অন্ধকার পাঠাই ইনবক্সে
তলপেটে হাত রেখে চমকে ওঠে বান্ধবীরা
 

১০।
আচমকা জেগে দেখি
বুকের ওপর অন্ধকার
সুদীর্ঘ পথ হয়ে আছে,  এ পথে কেউ ফিরে আসে না
সম্পর্ক ছিঁড়ে চলে যায় পুনর্জন্মের দিকে
যদিও গাছেরা জানে প্রতিটি জন্মের মধ্যে কান্না
মিহি মিহি শূণ্যতার জরিপ...
পাগলেরা লিখে ভরাট করে সেইসব
জল এসে জড়ো হয় স্তরে স্তরে
ছিদ্র দিয়ে ঢুকে পড়ে ভ্রম
তুমি তো জান
ঘুমিয়ে পড়লেই এজন্ম অবৈধ মনে হয় আমার
 

১১।
এই জঙলে আমি কোনো গাছ চিনি না
গাছের স্বপ্ন ভেঙে যারা চলে যায়
সেই পাতাকুড়ুনিদের সাথে কাঁচা সুপুরি ভাগ করে খাই
তারাই আমাকে প্রথম জানিয়েছে জীবনের সমস্ত আলো মিথ্যে
অন্ধরাই ফেরার পথ মনে রাখে
আমরা বাজারের ব্যাগ বইতে বইতে দুর্বল হয়ে পরি
নিচু হয়ে যায়
চারপাশে বেরাল ও কাক ওঁত পেতে থাকে
অশৌচের দিন-রাত্রি
আমরা কেবল বৃক্ষরোপণ উৎসব যাপন করি
অথচ কোনো গাছ চিনি না
 

১২।
সাহস জুগিয়েছি লাফিয়ে পড়ব
পৃথিবী একটা ছাদওয়ালা বাড়ি
ঝুঁকে পড়া, প্রাচীন...
যার প্রতিটি ঘর ভাঙাচোরা
প্রতিটি ঘর সম্পর্ক
আমি একেকটা সূক্ষ্মতা ভেঙে উঠে আসি
আর মরে যাওয়ার ভয় পাই
মরে যাওয়ার ভয়ে আমি জন্মাতে চাইনি কোনোদিন
অথচ আজ জীবনের শেষতম জাগলিং দেখাব আমি
মাটিতে অসংখ্য মানুষ, মা, বাবা, বোন...
ওপরে শূন্য
নীচে শূন্য
মাঝখানে আমি
পড়ে গিয়ে যেকোনো সময় শূন্যতা ভেঙে যাতে পারে

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

10 মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
Odvut ghorer lekha!
lighthouse বলেছেন…
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ!
Unknown বলেছেন…
Ar kono boi thakle poraben
Unknown বলেছেন…
Valo laglo kobir aro kobita chy
Unknown বলেছেন…
Ghorer lekha, notun o anyorakam byapar.khub valo laglo